রেমিট্যান্সের বড় উৎস হতে পারেন প্রবাসী ইমামরা

যুবায়ের আহমাদ ● ঢাকার মারকাজুত তানজিল আল ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের গৌরব হাফেজ মাওলানা সাইফুল জর্ডান, সৌদি আরব ও ইরানসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার হিসেবে বাংলাদেশে এনেছেন ১ কোটি টাকা। সম্প্রতি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পৃথিবীর ৭৩ দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল করে আমাদের কুমিল্লার কৃতী সন্তান হাফেজ আবদুুল্লাহ আল মামুন।

পুরস্কার হিসেবে পায় ২৬ লাখ টাকা। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ২১তম দুবাই হলি কোরআন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতায় ১০৩ দেশকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের হাফেজ তরিকুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাহরাইনের রাজধানী মানামায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন হিফজ ও কিরাত প্রতিযোগিতায় বিগত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে পৃথিবীর ৬০ দেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে প্রথমবারের মতো একই সঙ্গে কিরাত ও হিফজুল কোরআন উভয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন আমাদের হাফেজ জাকারিয়া।

জাকারিয়া ও তরিকুল নিয়ে আসেন দেড় কোটিরও বেশি টাকা। এভাবেই প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সন্তানরা বিজয়ী হয়ে কোটি কোটি টাকা রেমিট্যান্স নিয়ে আসছেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে ৪ হাজার মসজিদ। এসব মসজিদে বাংলাদেশী খতিব ও ইমামের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও আমিরাতের ৭০ ভাগ মসজিদের মুয়াজ্জিনই বাংলাদেশী। তবে যারা মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত আছেন, তারাও ইমামের মর্যাদাই পান। (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১১ আগস্ট, ২০১৭)।

যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ও সুকণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে তাদের অনেক কদর।

সেখানে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষক হিসেবে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাংলাদেশী দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা বাংলাদেশী টাকায় মাসে দেড় লাখ টাকা বেতন পান। এর বাইরে রয়েছে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া (সম্মানী উপহার)। পরিবার নিয়ে যাওয়া-আসা ও থাকার সব ব্যবস্থা করা হয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেই। যেহেতু থাকা-খাওয়ার খরচ হয় না; তাই তারা যা বেতন এবং হাদিয়া পান, তা দিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ২ লাখ টাকা তারা দেশে পাঠাতে পারেন।

সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের বাইরে রয়েছেন অনেক বেসরকারি ইমাম বা মুয়াজ্জিন। তাদের বেতন কিছুটা কম হলেও তারা কিছু ছাত্র পড়িয়ে আয় করতে পারেন অতিরিক্ত টাকা। ফলে তারাও প্রচুর অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। এভাবে মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন ও ধর্মীয় শিক্ষকরা।

পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী দেশ কাতারে কর্মরত আছেন প্রায় ১ হাজার ২০০ বাংলাদেশী ইমাম-মুয়াজ্জিন। কাতারে মসজিদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। সেখানে ইমাম নিয়োগ হয় সরকারিভাবে। বাংলাদেশী আলেমদের মেধা, আচরণ, মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াত, শুদ্ধ আরবি ও অন্যান্য সাফল্যের কারণে কতারিদের কাছে বাংলাদেশী ইমামদের ব্যাপক চাহিদা পূরণে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ থেকে কাতার সরকার ইমাম নেয়া শুরু করে।

কাতারের আমিরের রাজকীয় প্রাসাদের খতিবের পদসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের খতিব পদে বাংলাদেশী আলেম কর্মরত আছেন। কাতারে কর্মরত খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ২০০ হলেও খতিবের সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশই সহকারী ইমাম ও মুদাররিস (শিক্ষক)। খতিব ও মুদাররিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে বেতন পান ৭ হাজার ৭০০ রিয়াল বা ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৫ টাকা।

 

এর বাইরে রয়েছে মুসল্লিদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হাদিয়া (সম্মানী উপহার)। যারা শুধু সহকারী ইমাম ও শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, তারা পান ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪৫ টাকা বেতন।

কাতারে খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য পানি, বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ মানসম্মত আবাসন একেবারেই ফ্রি। চিকিৎসার খরচও বহন করে কাতার সরকার।

ইমামরা তাদের সন্তানদের কাতারের সরকারি বিদ্যালয়ে একদম ফ্রি পড়ানোর সুযোগ পান। ফলে তারা বেতন ও হাদিয়া যাই পান পুরোটাই দেশে পাঠাতে পারেন। গড়ে ২ লাখ টাকা দেশে পাঠালে প্রায় ২৫ কোটি টাকা প্রতি মাসে তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে।

সৌদি আরবে সাধারণত কোনো অনারব লোককে খতিব বা ইমাম পদে নিয়োগ দেয়া হয় না। তবে ইমামদের সহকারী, মুয়াজ্জিন এবং খাদেম হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন কোম্পানির মসজিদসহ সহকারী ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম হিসেবে বেসরকারিভাবে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশী কর্মরত। তারা মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা সম্মানী পান। মসজিদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু কাজও তারা করেন।

তাদের জন্য সপরিবারে আবাসনের ব্যবস্থা করে মসজিদ কর্তৃপক্ষই। অনেক ক্ষেত্রে খাবারও দেয় মসজিদ কর্তৃপক্ষ।

থাকা-খাওয়ার খরচ বেঁচে যাওয়ায় মসজিদের বেতন ও অতিরিক্ত হালকা কাজের যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো তারা দেশে পাঠাতে পারেন। এভাবে সৌদি আরবে সহকারী ইমাম বা মুয়াজ্জিন হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশী আলেমদের পক্ষ থেকে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে ইসলাম। মুসলমানের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মসজিদের সংখ্যাও। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে। সেগুলোতে রয়েছে বাংলাদেশী ইমামদের চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন মসজিদে কর্মরত বাংলাদেশী ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন হিসেবে ২ হাজারেরও বেশি আলেম আছেন। তবে তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশী কমিউনিটি পরিচালিত মসজিদগুলোয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশী কমিউনিটিতে প্রায় ৫০০ মসজিদ আছে। মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি তারা সেখানে শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ইভিনিং মক্তব, সাপ্তাহিক ক্লাস ও ইমামতি মিলে সপ্তাহে প্রায় ৫০০ পাউন্ড, মাসে ২ হাজার পাউন্ড বেতন পান ইমামরা। বর্তমান রেট অনুযায়ী (১ পাউন্ড ১১০ টাকা) মাসে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশী ইমামরা প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা বেতন পান।

তবে যুক্তরাজ্যে জীবনযাপন বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায় এর অনেকটাই তাদের খরচ হয়ে যায় সেখানেই। তবু হিসাব করে চললে প্রায় ১ লাখ টাকা প্রতি মাসে তারা দেশে পাঠাতে পারেন। সে হিসেবে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশী ইমামদের থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা যোগ হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মরত ইমামরা দেশের গৌরব বয়ে আনার পাশাপাশি মাসে প্রায় ১৫০ কোটি এবং বছরে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এ খাতে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নিতে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়া, সমঝোতা এবং ভিসা প্রসেসিংয়ের জটিলতার অবসানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধার হাত প্রসারিত করলে এ খাতে দক্ষ লোকবল দেশের পাশাপাশি বিদেশেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে বিশ্ব দরবারে।

লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, গাজীপুর।

The post রেমিট্যান্সের বড় উৎস হতে পারেন প্রবাসী ইমামরা appeared first on Comillar Barta.



from Comillar Barta http://ift.tt/2yoPxVG

October 16, 2017 at 03:28PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top