এই সেই ‘ব্লু হোয়েল’ খলনায়ক

ডেস্ক রিপোর্ট ● গত ৩-৪ বছর ধরে অভিভাবকদের কাছে অনলাইন গেম রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, লিগ অব লিজেন্ডস, মিনি মিলিশিয়া, পোকোমন গো’র মতো গেমের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণ-তরুণীর সংখ্যা নেহায়েত কম না। শুধু অভিভাবকরাই নন, অনলাইন গেমের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আসক্তি চিন্তা বাড়িয়েছে মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদেরও।

ইদানিং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যার ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’ নামের একটি সোশ্যাল গেমের। মোবাইলের ভেতরে চুপসে থাকা এই গেমটি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষও আতঙ্কিত। এরইমধ্যে এই গেমের কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীকে।

একটি অনলাইন ভিডিও গেম। অন্য অনলাইন গেমের মতোই এর কার্যক্রম। তবে শেষের ফলাফলটা হয় ভিন্ন। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, অনলাইনে কমিউনিটি তৈরি করে এ খেলা চলতে থাকে। এতে মোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো অতিক্রম করতে ওই কমিউনিটির অ্যাডমিন থেকে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ দিয়ে থাকে। অংশগ্রহণকারীরা সেই সব টাস্ক সম্পন্ন করে প্রমাণস্বরূপ ছবি বা ভিডিও পাঠায় বা নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়ায় সেগুলো পোস্ট করে। সর্বশেষ পঞ্চাশতম চ্যালেঞ্জটি হলো আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যা করতে পারলেই খেলোয়াড় বিজয়ী। খেলাটির অন্যতম বিশেষ দিক, একবার খেলায় অংশগ্রহণ করলে খেলাটি কোনোভাবেই বন্ধ (আনইন্সটল) করা যাবে না।

এমনকি কেউ বন্ধ করলে তাকে অনবরত নিজের এবং তার পরিবারের মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়। এডমিনদের সাথে অংশগ্রহণকারীদের যোগাযোগ করার উপায় সম্পর্কে কাউকে বলা নিষেধ। চ্যালেঞ্জ শেষ করার পর সমস্ত প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মুছে ফেলার নির্দেশনা থাকে। শুরুর দিকের চ্যালেঞ্জগুলো বেশ সহজ এবং অন্যান্য গেমের চেয়ে আলাদা হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা মজা পেয়ে থাকে। ধারাবাহিকভাবে প্রথমে সাদা কাগজে তিমি মাছের ছবি এঁকে খেলা শুরু হয়, ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। অংশগ্রহণকারীকে নিজের হাতে পিন বা ধারালো কিছু ফুটিয়ে নিজের রক্ত দিয়ে আঁকতে হয় পূর্বের কাগজে আঁকা তিমির ছবি। একা ভূতের ছবি দেখতে হয়, চ্যালেঞ্জের মধ্যে অতিরিক্ত মাদকসেবনও রয়েছে। প্রতিদিন একেকটি টাস্ক দেওয়া হয় এবং প্রতিটি দিনের মধ্যেই শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে।

এই গেমের আবিষ্কারক
২০১৩ সালে রাশিয়ায় গেমটির শুরু। ২০১৫ সালে গেমটির জের ধরে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং এরপর থেকে সারাবিশ্বে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’ নামের এই সোশ্যাল গেমিং-এর। এত কম সময়ের মধ্যে এত অল্প বয়সী মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা বিস্মিত করে পুলিশকেও। এদের মধ্যে সাইবেরিয়ার দুই স্কুলছাত্রী য়ুলিয়া কনস্তান্তিনোভা (১৫) এবং ভেরোনিকা ভলকোভা (১৪) একটি বহুতলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে বলে পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায়।

তদন্তকারী অফিসারদের তখন মনে হয়েছিল, এই সমস্ত আত্মহনন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, হয়তো কোনো গোপন যোগসূত্র রয়েছে এদের মধ্যে। মৃত্যুর পূর্বে য়ুলিয়া তার সোশ্যাল পেজে একটি তিমির ছবি পোস্ট করে লেখে ‘সমাপ্ত’। তদন্তে নেমে পুলিশের নজরে আসে এই ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’। পুলিশ আরও ধারণা করতে থাকে সারাবিশ্বে অন্তত ২০০ জন মানুষের আত্মহননের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী এই অনলাইন গেম। তবে এর জন্য দায়ী কে? কে এই গেমের আবিষ্কারক? কি তার পরিচয়? প্রশ্নগুলো জন্মেছে অনেকেরই মনে।

এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মৃত্যু কূপে ঠেলে দিচ্ছেন ফিলিপ বুদেকিন। তিনি রাশিয়ার নাগরিক। ১৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালে ব্লু হোয়েল নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এফ৫৭’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর ৫ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা করেন। ৫ বছরের মধ্যে যেসব মানুষ সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয় (তার মতে) তাদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ফিলিপ যখন এই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন তখন তিনি রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর পড়াশোনার পর ব্লু হোয়েলের বিষয়টি প্রকাশ হলে তাকে ২০১৬ সালে বহিষ্কার করা হয়। সেসময় তাকে গ্রেফতার করে রাশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফিলিপ ও তার সঙ্গীরা প্রথমে রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ভিকে’ ব্যবহার করে। সেখানে তারা একটি গ্রুপ তৈরি করে। গ্রুপে ভয়ের ভিডিও ছড়ানোর মাধ্যমে কাজ শুরু করে।

প্রথমে ভয়ের ভিডিও ছড়ানোর ফলে ওই গ্রুপে প্রচুর তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়। সেখান থেকে বুদেকিনের সঙ্গীরা মিলে এমন সব তরুণ-তরুণীদের বাছাই করতে থাকে, যাদের সহজে ঘায়েল করা সম্ভব হবে। সেন্ট পিটার্সবার্গ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে ফিলিপ বলেন, ‘যেখানে মানুষ আছে সেখানে কিছু জীবন্ত বর্জ্যও (মানুষ) আছে। সেসকল মানুষের সমাজে কোনো প্রয়োজন নেই। তারা হয় নিজেরা সমাজের জন্য ক্ষতি, না হয় তারা সমাজের ক্ষতির কারণ। আমি সমাজের ওই সকল বর্জ্য পরিষ্কার করতে চাই।’ তবে তিনি সরাসরি আত্মহত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আত্মহত্যার জন্য অনুপ্রাণিত করিনি। কিন্তু গেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা নিজেরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। গত মে মাসে এক গোপন বিচারের মাধ্যমে ফিলিপকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে কারাভোগ করছেন।

নামকরণ
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এত নাম থাকতে এই গেমের নাম ব্লু হোয়েল কেন রাখা হলো! সেটার আছে আলাদা একটি গল্প।

নীল তিমি নিজেই জীবনের একটি পর্যায়ে চলে আসে সমুদ্র তীরে, শুকনো ভূমিতে ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৮ সালে ৫৫টি নীল তিমি একযোগে সমুদ্র সৈকতে চলে আসে এবং উদ্ধারকারীরা তাদেরকে সাগরে ফেরত পাঠালেও তারা তীরের দিকে বারবার চলে আসে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আত্মহত্যাই যেন তাদের উদ্দেশ্য। ধাপে ধাপে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এই গেমটির নাম তাই ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন।

আকৃষ্ট করছে যেভাবে
ব্লু হোয়েলে সাধারণত অবসাদগ্রস্ত তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গভীররাতে বা একাকী দীর্ঘসময় যারা ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচরণ করে তারা এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার যে আগ্রহ সেটাকে কাজে লাগিয়ে ফাঁদে ফেলে এর কিউরেটররা। অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে সাহসের প্রমাণ দিতে বলা হয়। এজন্য তাদের ছোট ছোট কিছু সাহসী কাজ দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হয়।

একবার এতে জড়িয়ে পড়লে আর সহসা বের হওয়ার সুযোগ থাকে না। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এবং সাহস আছে কি-না-এমন কথায় সাহস দেখাতে গিয়ে দিনদিন তারা আকৃষ্ট হয় এই গেমে। তবে একবার এ খেলায় ঢুকে পড়লে আর বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি বাংলাদেশ যত বেশি ইন্টারনেটের প্রসার বাড়ছে, ততো বেশিই কিন্তু অনলাইনের আকর্ষণটা বাড়ছে। সেই অনলাইনের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই হচ্ছে আজকের এই ব্লু হোয়েল গেম । এই গেমে যারা আসক্ত তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জায়গায় আমাদের অভিভাবকদের শক্ত ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বা কলেজ পাস না করা পর্যন্ত কোনো ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল যেন তাদের সন্তানদের না দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফোন করার জন্য কম দামি ফিচার ফোন ব্যবহার করতে পারে। আর আমাদের দেশের শহরে যে অভিভাবকরা থাকেন তাদের সন্তানদের স্বাধীনতার নামে যেসব সুবিধা দেন সেগুলো কিন্তু অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। যারা গেমস ব্যবহার করছে, সেই সন্তানদের সঙ্গে কিন্তু একটা বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে। আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয় আছে, তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করতে পারে। আমাদের দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বা অ্যাক্সেস কতটুকু হবে, এটা মনে হয় রাষ্ট্রের এখন বেঁধে দেওয়ার সময় হয়েছে।’

The post এই সেই ‘ব্লু হোয়েল’ খলনায়ক appeared first on Comillar Barta.



from Comillar Barta http://ift.tt/2yoswUn

October 14, 2017 at 11:57PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top