আসাম, ২৩ অক্টোবর- ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে আরেকটি জাতিগত সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজ্যগুলোতে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরলক্ষ্য করে এই সহিংসতা শুরু হতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে এসব রাজ্যের কয়েকটির আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী মহল অবৈধ অভিবাসী ও বিদেশিদের (পড়ুন বাংলাদেশি) বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। শুরুর দিকে তাদের লক্ষ্য আসাম, মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশ। আসামে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে বিভক্ত। এদের একাংশের দাবি রাজ্যটিতে বেশ কিছু বাংলাদেশি সেটেলার রয়েছে, একারণে এদের নাগরিকত্বের নথি যাচাইয়ে তৎপর তারা। তবে এ কাজে বাংলাদেশি শনাক্ত হোক না হোক, এ অঞ্চলের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানরা যে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য। দলটির অপর অংশ এসব ক্ষেত্রে উদার মনোভাব দেখানোর পক্ষে। কারণ, স্থানীয় অনেকেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফলে এ কারণে অনেকেই হয়রানির শিকার হতে পারেন। সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে দলটির শীর্ষনেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল। বিদেশি-বিরোধী আন্দোলনের অনেক উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি এর আগেও সক্রিয় ছিলেন। এসব কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোই ছিল সহিংসতাপূর্ণ। সেই সর্বানন্দ আসামের নাগরিকদের নাগরিকত্ব পুনরায় যাচাই ও সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীদের সংশ্লিষ্ট নথি জমা দেওয়ার অভিযানে সমর্থনও দিয়েছেন। রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপে এরই মধ্যে আসামের উঁচু জেলায় বসবাসকারী বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলিমদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ স্থানীয় পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র জমা দিয়েছেন। যারা আগে এমন প্রমাণপত্র দিয়েছিলেন তারা আবারও একই কাগজ জমা দিয়েছেন নতুন জায়গায় বসবাস করার ক্ষেত্রে হয়রানি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এসব মানুষের দুর্ভোগের কথা আসামের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রকাশিতও হচ্ছে। আর নাগরিক অধিকার রক্ষায় আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো আইনি জটিলতা সমাধানে সহযোগিতা করেছে। বলা যায়, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ বিজেপির কট্টরপন্থী অংশকে শক্তি জুগিয়েছে। মোদি বলেছিলেন, বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় যাওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের তল্পি-তল্পা গুছিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মোদির অনেক নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। মোদির অন্যান্য নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে আনা, বছরে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও পণ্যের দাম কমানো। ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পার হওয়ার পর বিরোধী কংগ্রেস ও বামদলগুলো নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে মোদির ব্যর্থতা জোরেশোরে তুলে ধরছে। তবে, মোদির ওই ভাষণকে ভিত্তি ধরে নিয়ে আসামে বিদেশি তাড়াতে এখন সক্রিয় রাজ্য বিজেপি। বিশেষ করে সেখানে বৈধ কাগজ না থাকা মানুষদের বাংলাদেশি দাবি করে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইঙ্গিত দিয়েছে তাদের আগের অভিবাসন নীতিই কার্যকর থাকবে। ওই নীতি অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে, কিন্তু অন্যরা পাবে না। এর ফলে এখানে থাকা মুসলমানদেরই যে বেশি হেনস্তার শিকার হতে হবে তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার চাকরিসহ অন্যান্য সরকারি কাজে আধার কার্ডকে দৃশ্যত আবশ্যক করেছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হচ্ছে। এতে করে আসামের অনেক মানুষই অস্থিরতা বোধ করছেন। সেখানে পরিস্থিতি এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে নাগরিকত্ব বৈধ কাগজপত্র ছাড়া যেকোনও ব্যক্তিই আসামে অবৈধ অভিবাসী। বন্যাপ্রবণ আসামের গ্রামীণ এলাকার অনেক মানুষই বৈধ নাগরিকত্বের কাগজপত্র ছাড়াই দশকের পর দশক বাস করে আসছেন। এখন ধীরে ধীরে অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। ফলে কাগজপত্রহীন অনেকেই বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ছেন। নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে রাজ্য কর্তৃপক্ষ প্রধানত দরিদ্র মুসলিমদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ ভিনদেশি হিসেবে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। অনেক সংগঠন এই বিষয়ে তাদের প্রচারণা পুনরায় শুরুর ডাক দিয়েছে। অরুণাচলে অন্যান্য ধর্মালম্বী ও জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি অরুণাচল কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক দল চাকমা ও হাজং আদিবাসীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে আপত্তি তুলেছে। প্রদেশটিতে এই দুই আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারও হবে না। কিন্তু মাত্র দশ লাখ জনসংখ্যার রাজ্যে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অনেক। এসব আদিবাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত সংঘাতের মুখে পালিয়ে আসার পর থেকেই সেখানে বিশেষ ক্যাম্পে বাস করছে। চীন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অরুণাচলে আসা মানুষদের নাগরিকত্ব দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন পরিকল্পনায় রাজ্যটি বিভক্ত। মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু এই প্রস্তাবকে সমর্থন করছেন এবং তার মন্ত্রিসভা পরিকল্পনাটি অনুমোদন দিয়েছে। রাজ্যের বিরোধী দলগুলো জানতে চেয়েছে, এতে করে স্থানীয়দের স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে। তাদের পরামর্শ এ বিষয়ে সরকারে ধীরে আগানো উচিত। কলকাতা ও দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষকরা মনে করেন পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিলে এসব রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারতো। কারণ, এসব রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়ে স্পর্শকাতর। আর যদি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেক প্রাণহানি হতে পারে, ক্ষতি হতে পারে সম্পদের। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেও জটিলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা সব সময় বাংলাদেশি প্রমাণ না হওয়া মানুষদের ভারত হতে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। সহসাই এ অবস্থান পরিবর্তিত হবে না। আর অরুণাচলকে তিব্বতের অংশ মনে করে চীন। তিব্বতিদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ফলে ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক বিরোধ শুরু হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করছেন। এমএ/১২:১০/২৪ অক্টোবর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2zK9SFl
October 24, 2017 at 06:14AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top