অস্তিত্ব সংকটে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি

নিজস্ব প্রতিনিধি:: সিলেটের ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত শীতলপাটি অস্তিত্ব সংকটে ভূগছে। নিজেদের প্রয়োজনে মুর্তা উজাড় করে ফেলার কারণে বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরে মুর্তার বাগান হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনও দিন ছিল বিভিন্ন খাল-বিল ও লোকালয়ের পাশে প্রচুর মুর্তা পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে মুর্তা দুঃস্প্রাপ্য হয়ে ওঠেছে।

আশির দশকে সরকার মুর্তা উৎপাদনের জন্য কৃষকদের ঋণ দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে এখন আর সচরাচর মুর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাটি শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। হস্ত ও কুঠির শিল্পকে উৎসাহিত করতে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও শীতল পাটির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে তাদের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা।

অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, মৃতপ্রায় এ শিল্পকে ঠিকিয়ে রাখতে হলে সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান ও সঠিক বাজার মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে এ শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। জানা যায়, মুর্তার সরু গাছ ৮-১০ দিন পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর তা শুকিয়ে মুর্তাগাছের ছাল থেকে হালকা বেত বা আঁশ তৈরী করা হত। পরে বেতগুলো বিভিন্ন প্রকার রঙে ডুবিয়ে শিল্পীরা দক্ষ হাতে বুনন করে একের পর এক শীতল পাটি তৈরী করতেন।

ঢাকার বিখ্যাত মসলিনের মতো শীতল পাটিও এক সময় ছিল সৌন্দর্য্য ও শিল্পের প্রতিক। শীতল পাটি হরেক রকমের হয়ে থাকে। এর মধ্যে পয়সা, শাপলা, সোনামুড়ি, জয়পাটি, টিক্কা, সিকি, লাল গালিছা, আধুলি, মিহি প্রভৃতি পাটির কদর ছিল বেশী। কথিত আছে, মিহি পাটি এমনভাবে মিহি ও পিচ্ছিল করে তৈরী করা হতো যে একটা পিঁপড়া পর্যন্ত এর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারতো না। শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িতরা হিন্দু সম্প্রদায়ভূক্ত। আর তাই পাটিতে তারা নানা ধরনের মন্দির, ত্রিশূল ও আলপনার আদল তৈরী করত। হালের তাজ মহলও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি।

বৃটিশ আমলে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রাসাদের বালাগঞ্জের শীতল পাটি অভিজাত্য হিসাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। বাড়িতে নতুন জামাই কিংবা পরম কাঙ্খিত অতিথি এলে শীতল পাটি বিছিয়ে বসতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কেউ অপারগ হলে লজ্জায় পড়তে হতো। শীতল পাটি একসময় হয়ে ওঠে এদতাঞ্চলের মানুষের সভ্যতার মাপকাঠি। বৃটিশ-পাকিস্থান আমলেও শীতল পাটির কদরের কমতি ছিলনা।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শীতল পাটি শিল্প বাজারে প্রচুর মার খেতে শুরু করে। বর্তমানে শীতল পাটি শিল্পীদের জীবন একেবারে নাজুক। বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া, চাঁনপুর, আতাসন, শ্রীনাথপুর, গৌরীপুর, মহিষাসি, লোহামোড়া, প্রভৃতি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক লোক শীতল পাটি শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু শ্রম ও বাজার মূল্যের প্রচন্ড ব্যবধান শিল্প তৈরীতে শিল্পীকে বিমুখ করে তুলেছে। বৃটিশ কিংবা পাকিস্থান আমলে বিভিন্ন দেশ থেকে বণিকরা বালাগঞ্জে জাহাজ ভেড়াতো। সেখানে বিভিন্ন পন্য বিক্রয় শেষে তারা নিয়ে যেত বাহারী শীতল পাটি।

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়ায় শীতল পাটির কদর ছিল ঈর্শনীয়। ভারত বর্ষে আগমনে প্রমাণ হিসাবে ভিন দেশীরা ঢাকা মসলিনের পাশাপাশি বালাগঞ্জের শীতল পাটি নিয়ে যেত স্মৃতি হিসাবে।

রাজনগর উপজেলার বিলবাড়ি গ্রামের যতীন্দ্র দাসের ছেলে জগদীস দাস। পাটি তৈরি-ই তার পৈত্রিক পেশা। কয়েক যুগ ধরে তিনি বালাগঞ্জ এলাকাসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে পাটি বিক্রি করে আসছেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি বাবার কাছ থেকে পাটি তৈরি করা শেখেন। তখন বাবার সাথে মিলে তারা সপ্তাহে দুটি পাটি তৈরি করে বাজারে বিক্রয় করতেন। সে-সময়ে একটি পাটি ২০ টাকায় বিক্রি হত। তাতেই বাজার-সওদা করে সংসার চলত। আগের মতো এখন কম সময়ে পাটি তৈরি করে কম টাকায় বিক্রি করা খুবই কঠিন ব্যাপার। বর্তমানে সাধারণ পাটির মূল্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা। তারপরও মুনাফা হয় কম। আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি। দেশের অনেক শিল্পে আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। কিন্তু এই শিল্পটি এখনো আগের মতোই আছে।

জগদীস দাস বলেন, শীতল পাটি তৈরিতে সেই মান্দাতার আমলের দা ব্যবহার করা হয়। আর পাটির কারিগররা হাত দিয়ে বুনে যাচ্ছেন পাটি। এর পরিবর্তন কবে হবে জানিনা ।

শীতল পাটি তৈরীর উপকরণ:- শীতল পাটি শিল্প গড়ে ওঠার মূল কারণ শীতল পাটি তৈরির প্রধান উপকরণ মূর্তা গাছ। সিলেট অঞ্চলের মাঠি ও আবহাওয়া মূর্তা গাছের জন্য সহায়ক। এই গাছ থেকে আহরিত বেত দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে শীতল পাটি। বিশেষ ধরনের এই গাছ বনাঞ্চলের স্যাঁতসেঁতে মাটি ও বাড়ির পাশ্ববর্তী ভেজা নিচু জমিতে হয়ে থাকে। ডোবা অথবা পুকুরের একপাশেও মূর্তা গাছ হয়। আঞ্চলিকভাবে সহজলভ্যতা এই শিল্পকে করেছে ব্যাপক। তবে আধুনিকতা এই শিল্পের টুটি চেপে ধরেছে। আগে পাটির শীতলতা মানুষকে যেখানে প্রশান্তি দিত, সেখানে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর শীতলতায় এখন স্বস্থি নিচ্ছে মানুষ। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারেই শীতল পাটির কদর ছিল, আছে। চাহিদার কারণেই শীতল পাটির রয়েছে হরেক রকম নাম। তবে নাম অনেক ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য প্রস্থের ওপরও নির্ভর করে। বেতের প্রস্থের মাপে বিভিন্ন নামে শীতল পাটির নামকরণ করা হয়ে থাকে।

শীতল পাটির স্বর্ণ পদক লাভ:- ১৯০৬ সালে কলকাতায় কারুশিল্প প্রদর্শনীতে বালাগঞ্জের যদুরাম দাস শীতল পাটির জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৯১ সালে বিশ্বের কারু শিল্পের এক প্রদর্শনী ইতালীর রোমে অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রদর্শনীতে রাজনগরের বিল বাড়ী গ্রামের মনিন্দ্র নাথ এদেশীয় প্রতিনিধি হিসাবে শীতল পাটি নিয়ে অংশ গ্রহন করেন। শীতল পাটির বুনন শৈলী অন্যান্য দেশের শিল্পীদের প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ট কারুশিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি পান বালাগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামের পবন জয় দাস। আমাদের সঙ্গে এমন অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। একেকটি পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ শিল্পীর ৩-৪ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। যার ফলে বর্তমানে শীতল পাটির দাম অত্যধিক। শীতল পাটির বদৌলতে বালাগঞ্জের শিল্পীরা দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।

শীতল পাটি শিল্প হুমকির মুখে:- বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি নানা ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে পাটি তৈরি করে বাজার সয়লাভ করে দিয়েছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদ মূর্তা বেতের পাটিশিল্প অনেকটা হুমকির মুখে। তবে মূর্তা বেতের তৈরি পাটি অনেক আরামদায়ক, স্বাস্থ্যসম্মত ও প্রকৃতিবান্ধব হওয়ায় সারাদেশে সিলেটের রকমারি শীতল পাটির চাহিদা প্রচুর। এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা জোড়ালো হলে দেশ-বিদেশে এই পণ্যটি প্রসার লাভ করবে। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্বে দেশের পরিচিতি ঘটবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এর জন্য প্রয়োজন পাটির কারিগরদের প্রশিক্ষণ। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজারজাতের উদ্যোগ নিতে হবে। এই পাটিশিল্পের সঙ্গে বৃহত্তর সিলেটের নানা স্থানে কয়েক হাজার শ্রমিক জড়িত।

শীতল পাটি শিল্লীদের কথা:- এটি বাপ-দাদার পেশা বলে এখনো এ পেশার সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন পাটি শিল্পীরা। কিন্তুছেলে বা মেয়েদের এ পেশার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেননি তারা। সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে মূর্তা বেত চাষ করে এবং কারিগর তৈরি করে প্রশিক্ষণ দেয়, তাহলে সিলেটে বেশ কয়েকটি পাটি করখানা গড়ে ওঠতে পারে। পাটি তৈরির মধ্যে একটা শৈল্পিক সত্তা কাজ করে। তাই শিল্পটি ভালো লাগে। অদূর ভবিষ্যতে এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ঠিক ওইভাবে মূর্তা বেতের চাষ না হলে এ শিল্পটি কাঁচামালের অভাবে হারিয়ে যাবে।

এখন গ্রামাঞ্চলে মুর্তা পাওয়া যায় না। দূর থেকে মুর্তা কিনে আনতে যে টাকা খরচ হয় সব কিছু বাদ দিয়ে নিট মুনাফা আসে এর চেয়ে কম। এতে উৎসাহ হারায় পাটি শিল্পীরা। একটা পাটি তৈরীতে কমপক্ষে মাস খানেক সময় লেগে যায়। কিন্তু বাজারে তা বিক্রি করলে ৩০০-৩৫০ টাকার বেশী মূল্য পাওয়া যায় না। ফলে শ্রম মূল্য না পাওয়ায় অনেকেই এখন আর শীতল পাটি তৈরীতে আগ্রহী নন। এজন্য দিনদিন মানুষের ঘর থেকে সরে গিয়ে শীতল পাটি শোভা পাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2kb6HPO

December 08, 2017 at 09:11PM
08 Dec 2017

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top