মুম্বাই, ১৩ ডিসেম্বর- কিছু দিন আগে শশী কাপুরের মৃত্যুতে সংবাদমাধ্যমে আবার হিন্দি ছবির ফেলে-আসা কাল নিয়ে কিছুটা চর্চা চোখে পড়ল, এমনিতে তো হালফিলের পেশিসর্বস্ব (উভয় অর্থেই) বলিউডে ইতিহাস-তিটিহাস নেহাত বাতিলের খাতায়। কিংবা তার স্থান পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ভিন্টেজ আসবাব হিসেবে। আর এ-ও একটা ধাঁধা যে জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ছাড়া অতীত ভারতীয় অভিনেতাদের নিয়ে কথা বলার মতো ফুরসত আমাদের হয় না। তাই আজ, ১৩ ডিসেম্বর, দিলীপ কুমার যখন ৯৫-এ পা রাখছেন তখন এই মওকাটা ছাড়ব কেন! দুর্ভাগা এই দেশ, যেখানে দিলীপ কুমারের মতো অভিনেতাকে নিয়ে লেখালিখি নেহাতই হাতেগোনা। দিলীপ কুমারের একটা নিজের-মুখে-নিজের-কথা গোছের আত্মজীবনী বাজারে পাওয়া যায় বটে (দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ্যাডো নামক এই বইয়ের অনুলেখিকা উদয়তারা নায়ার), এ ছাড়া আছে সঞ্জিত নাড়ওয়েকারের দিলীপ কুমার: দ্য লাস্ট এম্পারার বা লর্ড মেঘনাদ দেশাইয়ের বই। কিন্তু এ সব যথেষ্ট ধারেকাছেও আসে না। একবার চোখ বুজে যে কোনো মাঝারি মানের হলিউডি অভিনেতার সঙ্গে তুলনা টেনে নিন, তফাতটা টের পেয়ে যাবেন। দিলীপ কুমারের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পেশোয়ারে। এই পেশোয়ারই ভারতীয় চলচ্চিত্রকে উপহার দিয়েছে কাপুর পরিবারকে। দিলীপ কুমারের পরিবার তিরিশের দশকেই বম্বেতে চলে আসে। জনশ্রুতি অনুযায়ী (উর্দু ভাষার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চল্লিশের দশকের হিন্দি ছবির চিত্রনাট্যকার সাদাৎ হাসান মান্টোরও সে রকমই মত) বম্বে টকিজের সর্বেসবা হিমাংশু রায়ের স্ত্রী ও ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম স্টার-নায়িকা দেবিকা রানি দিলীপ কুমার ওরফে ইউসুফ খানকে প্রথম আবিষ্কার করেন পুনের এক মিলিটারি ক্যান্টিনে। দিলীপ তখন ওই ক্যান্টিনের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু সম্ভবত মোলাকাতটা ঘটেছিল সিমলায়। অভিনয়ের প্রথম প্রস্তাবটা এই তরুণ প্রত্যাখানই করেছিলেন। এর কিছু দিন পর বম্বের চার্চগেট স্টেশনে তাঁকে পাকড়াও করেন হিমাংশু রায়ের চিকিৎসক ডাঃ মাসানি। এই মাসানি সাহেবই তাঁকে বম্বে টকিজে নিয়ে যান। দেবিকা রানি তাঁর নাম দেন দিলীপ কুমার। ১৯৪৪ সালে প্রথম ছবি জোয়ার ভাটা বক্স অফিসে ডাহা ফেল। উপরন্তু সে আমলের নামজাদা ফিল্ম পত্রিকা ফিল্ম ইন্ডিয়া-র জাঁদরেল সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল তরুণ নায়ককে স্রেফ ধুয়ে দিলেন। পরের ছবির দশাও তথৈবচ। ১৯৪৭ সালে মুক্তি-পাওয়া জুগনু ছবিতে দর্শকরা খুঁজে পেল তাদের মনের মতো এক নায়ককে। সে ছিল এক অন্য দিনকাল। উত্তাল চল্লিশ। দেশ সবে স্বাধীনতার মুখ দেখছে, বম্বের চলচ্চিত্র জগতে চলছে স্টুডিও যুগ। আর এ সবের মধ্যেই সদ্যোজাত গণতন্ত্রের নাগরিকরা খুঁজে পাচ্ছে তাদের স্বপ্নের নায়ককে। যিনি একই সঙ্গে রোম্যান্টিক এবং ট্র্যাজিক। এখানে দিলীপ কুমারের অভিনয়-শৈলী নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই। শুধু তিনটে ছবির কথা একটু খেয়াল করব। দিদার (১৯৫১)। নীতিন বোস পরিচালিত এই ছবিতে দিলীপ কুমার একজন অন্ধ মানুষের ভূমিকায়। হিন্দি ছবিতে কত অভিনেতাই তো চিত্রনাট্যের খাতিরে অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবিতে দিলীপ কুমারের চোখের ব্যবহার দেখুন। একজন অন্ধ মানুষের তাকানোটা ঠিক কী রকম হয়? অন্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় সে তো কানে-শোনার আন্দাজে সেই অন্য লোকটির মুখের দিকে তাকায়, আবার চোখে দেখতে পাচ্ছে না বলে তার শরীরি অভিব্যক্তি তথা তাকানোতে কোথাও একটা অনিশ্চয়তাও থাকে। এই সবটুকু যে ভাবে ধরা পড়েছে দিলীপ কুমারের অভিনয়ে তা আজও যে কোনো বলিউডি অভিনেতার পক্ষে শিক্ষণীয়। এই ছবি দেখে হলে দর্শকরা কী ভাবে কান্নায় ভেঙে পড়ত, তার বর্ণনা আছে বিক্রম শেঠের এ স্যুটেবল বয় উপন্যাসে। গঙ্গা যমুনা (১৯৬১)। এটাও সেই নীতিন বোসেরই ছবি। সামন্ততান্ত্রিক গ্রামসমাজের অত্যাচারে ছবির নায়ক ডাকাত বনে যাচ্ছে (গঙ্গা যমুনা-র পর এই ধরনের একাধিক হিন্দি ছবি হয়েছে, শোলে থেকে এর একটা উলটো ছক চালু হয়)। রাজ কাপুর থেকে আমির খান পর্যন্ত কত অভিনেতাই তো গ্রামবাসীর ভূমিকায় অভিনয় করলেন (এঁদের কাউকেই ছোটো করাটা অবশ্যই এখানে উদ্দেশ্য নয়।)। কিন্তু শুধু হাঁটাচলা বা সংলাপ বলার ধরনে নয়, দিলীপ কুমার এই ছবিতে তাঁর শারীরিক ছন্দের মধ্যে একটা দেহাতিপনা এনেছিলেন। এর কয়েক বছর আগেই কিন্তু বি.আর. চোপড়ার নয়া দৌড় (১৯৫৭) ছবিতে দেহাতির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। কিন্তু সে আরেক ধরনের অভিনয়, গঙ্গা যমুনা-তে তাঁর অভিনয়-শৈলী একেবারেই আলাদা। যত বার দেখি নতুন করে অবাক হই। মশাল (১৯৮৪)। এই পর্যায়ের ছবিগুলোর মধ্যে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে শক্তি বা সুভাষ ঘাইয়ের কর্মা-কেও বেছে নিতে পারতাম। কিন্তু যশ চোপড়ার এই ছবিতে দিলীপ কুমার অভিনীত চরিত্রটি বিবেকবান এক সাংবাদিক থেকে স্ত্রীর মৃত্যুর বদলা নেওয়ার জন্য হয়ে উঠছে এক দুর্ধর্ষ অপরাধী। নেহাতই চেনা ছক। কিন্তু ছবির এই দুই পর্বে বাষট্টি বছর বয়সি দিলীপ কুমারের অভিনয়ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। ছবির দ্বিতীয় পর্বে তিনি পুরোপুরি পালটে নিয়েছেন তাঁর শরীরি ভাষা, কথা বলার ধরন, এমনকি গলার স্বর। আর ফুটপাথে পড়ে-থাকা অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার গাড়ি থামিয়ে সাহায্য চাওয়ার সেই দৃশ্যে তাঁর অভিনয়? সে তো হিন্দি ছবির ইতিহাসে একটা মাইলফলক। অনেক ব্যাপারেই তিনি অনন্য। ১৯৪৪ সালে জোয়ার ভাটা ছবি দিয়ে তিনি হিন্দি ছবির দুনিয়ায় পা রাখেন, আর তাঁকে শেষ দেখা গেছে ১৯৯৮ সালে মুক্তি-পাওয়া উমেশ মেহরার কিলা ছবিতে। এই ছ দশক জোড়া অভিনয়-জীবনে তাঁর ছবির সংখ্যা মোটে ষাট! যা আজকের দিনে কল্পনাও করা যায় না। আসলে তিনি এক অন্য জগতের বাসিন্দা। হিন্দি ছবির স্বর্ণযুগ নিয়ে তাঁর শো ক্লাসিক লেজেন্ডস-এ জাভেদ আখতার বলেছেন, কোহিনুর (১৯৬০) ছবিতে একটা গানের দৃশ্যে দিলীপ কুমার একবার সামান্য একটু কাঁধ ঝাঁকিয়েছেন, হলে ছবিটা চলাকালীন ওইটুকুতেই দর্শকরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত। এর পর জাভেদের সংযোজন, আজকের ভাঁড়ামি-সর্বস্ব বলিউডে যখন লোক হাসানোর জন্য অভিনেতারা দু-চারটে বাড়ি ধসিয়ে ফেলেন, তখন কে আর নজর করবে অভিনয়ের ওই সূক্ষ্মতাটুকু! ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই শেষ সম্রাটের ৯৫তম জন্মদিনে তাঁকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সূত্র:খবর অনলাইন এমএ/১২:০০/১৩ ডিসেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2nTS6xg
December 13, 2017 at 06:11PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন