নিউ ইয়র্ক, ২৮ জানুয়ারি- জিয়া উদ্দিন আহমেদ। সদা কর্মচঞ্চল এই মানুষটি পেশায় চিকিৎসক। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিদের অন্যমত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছেন কেউ, এমন নজির নেই। আমেরিকায় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সব সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন একাত্তরের এই বীর সেনা। কোনো সংগঠনের উপদেষ্টা, কোনোটার চেয়ারম্যান, কোনোটির সভাপতি আবার কোনোটির চিফ পেট্রোন তিনি। তাঁর বাবা শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনিও ছিলেন চিকিৎসক। একাত্তরে মানবতার সেবায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন শামসুদ্দিন আহমেদ। পাকিস্তানিদের হাতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সিলেট সদর হাসপাতালে হায়নাদের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়েছে তাঁর বুক। সংকটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার বেদীমূলে। হাসিমুখে আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। অন্যদিকে, দেশমাতৃকাকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাঁরই সন্তান জিয়া উদ্দিন হাতে তুলে নেন অস্ত্র। যুদ্ধ করেন জীবন বাজি রেখে। লড়াই শেষে সিলেটে ফিরে তিনি জানতে পারেন, স্বাধীনতার বেদীমূলে প্রাণ গেছে প্রাণপ্রিয় বাবার। সঙ্গীহারা হয়েছেন কল্যাণব্রতী মা হোসনে আরা আহমেদ। সেদিনই জিয়া উদ্দিন আমৃত্যু বাবার মতো মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকার শপথ নেন। সেই থেকে আজ অবদি মানবকল্যাণ থেকে একদিনের জন্যও দূরে সরেননি! যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান হিসেবে দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত রয়েছেন তিনি। ১৯৫২ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া জিয়া উদ্দিন আহমেদ মা-বাবার হাত ধরে শৈশবেই যুক্ত হন মানবসেবায়। দরিদ্রদের সহায়তায় বাবা শামসুদ্দিন আহমেদ পরিচালিত প্রতিটি মেডিকেল ক্যাম্পের সঙ্গেই যুক্ত থাকতেন তিনি। আর নারী শিক্ষার প্রসারে মাকে দিয়েছেন যোগ্য সন্তানের মতো সঙ্গ। একদিকে সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তি, অন্যদিকে চালিয়ে যেতে থাকেন লেখাপড়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্চ মাসেই বন্ধু কর্নেল এম এ সালামের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ৩ নম্বর সেক্টরে মেজর হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনে অংশ নেন। যুদ্ধ শেষে সিলেটে ফিরে বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে মুষড়ে পড়েন। বেদনায় নীল হয়ে যায় তাঁর শরীর! পারিবারিক অগ্রযাত্রায় ঘটে ছন্দপতন। এই পরিস্থিতিতে দৃঢ়চেতা মা হোসনে আরা আহমদের প্রচেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কঠিন একটি সময় পাড়ি দিয়ে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেন এমবিবিএস। এরপর ১৯৮০ সালে উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমান আমেরিকায়। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন পরিস্থিতি, কিন্তু হৃদয়ে স্বদেশকে লালন করে সমৃদ্ধির পথে শুরু হয় তাঁর পথচলা। আরও পড়ুন: নিউইয়র্কে দুই মিলিয়ন ডলার পেলেন এক বাংলাদেশি আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে থাকেন জিয়া উদ্দিন। সময় পরিক্রমায় তাই আজ যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালির সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখতে নিত্য ব্যস্ত থাকেন। মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিউইয়র্ক বইমেলা আয়োজনে যেমন তাঁর অনন্য ভূমিকা রয়েছে, তেমনি তাঁর উদ্যোগে বেশ কয়েকটি সংগঠনে বিভেদ ভুলে একত্র হয়েছে বাঙালিরা। এ রকম একটি ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে নিউইয়র্কে আয়োজিত বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে। আমেরিকায় এই সম্মেলনের সফল আয়োজন করে তিনি যে নজির স্থাপন করেছেন তা এক কথায় অনন্য। শেকড়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণেই তাঁর হাত ধরে এসেছে এমন সাফল্য। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদসহ অসংখ্য বিশ্ববরেণ্য সিলেটির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি হয়েছে ঋদ্ধ। কিডনি, মেডিসিন, হাইপার টেনশন, ক্রিটিক্যাল কেয়ারসহ মোট পাঁচটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিমান জিয়া উদ্দিন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের চিকিৎসা সেবার উন্নয়নেও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আমেরিকার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপক ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমুদিনি হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কিডনি ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের চিকিৎসা উপকরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই সঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধনে বিদেশি চিকিৎসকদের দিয়ে দেশে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তাঁরই প্রচেষ্টায় সিলেটে বাস্তবায়ন হতে চলেছে কিডনি হাসপাতাল। খুব শিগগির শুরু হতে যাচ্ছে এই হাসপাতালের কার্যক্রম। কিডনি হাসপাতালে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে রোগীদের। এই হাসপাতালের আয়ের পুরো অর্থই ব্যয় হবে হাসপাতালের উন্নয়নে, রোগীদের সাহায্যে। অন্যদিকে ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রবাসীদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জিয়া উদ্দিন। শ্রীপুরে তাঁরই উদ্যোগে গড়ে উঠেছে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন এমন প্রবাসীদের জন্য একটি গ্রাম। এনআরবি ভিলেজ নামে প্রতিষ্ঠা করা এই গ্রামে কেবল সেসব প্রবাসীই থাকতে পারবেন, যারা দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত রয়েছেন। এ ছাড়া শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ ট্রাস্ট ও হোসনে আরা আহমেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিবছর দরিদ্র, অসহায় ও মেধাবীদের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করে চলেছেন। এ পর্যন্ত এই দুটি সংস্থার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন হাজারো মানুষ। শহীদ শামসুদ্দিন ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে ১৫টি দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা এবং হোসনে আরা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ১১ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে এই বৃত্তি দেওয়া হয়। তবে এই উদ্যোগটিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ব্যতিক্রমী পন্থায়। সিলেটের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ১১ ব্যক্তির নামে চালু করা হয়েছে এ বৃত্তি। এর মাধ্যমে ওই ১১ জন গুণীকে নতুন প্রজন্মের কাছেও তুলে ধরে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সিলেট নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে লালনের যে প্রয়াস সেটি তাঁকে চির ভাস্বর করে রাখবে কালের ক্যানভাসে। জনকল্যাণমূলক এসব কর্মকাণ্ডে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে ডা. ফাতেমা আহমদের যেমন অনন্য ভূমিকা রয়েছে, তেমনি অবদান আছে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীরপ্রতীক কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালামের। তাঁদের নিয়েই জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন জিয়া উদ্দিন। একাত্তরে দেশ নির্মাণে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, আজ তেমনই সমৃদ্ধ দেশ গঠনেও ভূমিকা রেখে চলেছেন এই চিকিৎসক। তাঁর মতে, কোনো সরকারের একার পক্ষে কখনোই একটি স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ দেশ গঠন সম্ভব নয়। এ কারণে প্রয়োজন নাগরিকদের ভূমিকা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই স্বপ্নের স্বদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জন করেই মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ শেষ হয় না। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় আমৃত্যু। সেই যুদ্ধই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সূত্র: প্রথম আলো আর/০৭:১৪/২৮ জানুয়ারি



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2nmTEg2
January 28, 2018 at 01:55PM
28 Jan 2018

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top