বিশেষ প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ শনিবার। ২০০৫ সালের এই দিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে গ্রেনেড হামলায় তিনিসহ ৫ জন নিহত ও কমপক্ষে শতাধিক লোক আহত হন। ঘটনার ১৩ বছর পার হলেও হত্যার বিচার কাজ এখনও শেষ হয়নি।
কিবরিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানান, হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ বছর পর সম্পূরক অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিলের মাধ্যমে বিচার কাজ শুরু হয়। এরপর থেকে কেবল শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে, বিচার কাজ আর শেষ হচ্ছে না। সময় যত গড়াচ্ছে বিচার পাওয়া নিয়ে তাদের শঙ্কাও বাড়ছে।
জানা যায়, ২০০৫ সালে ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া নিহত হন। একই ঘটনায় আরও নিহত হন এ এম এস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী। হত্যাকাণ্ডের রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। মামলার বাদী, কিবরিয়ার স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের অভিযোগ, তখন মামলাটির ‘স্বাভাবিক’ তদন্ত না হয়ে তা ‘দলীয় বিবেচনায়’ চলতে থাকে।
আদালত সূত্র জানায়, সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্ত করে ২০০৫ সালের ২০ মার্চ ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি দেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। এ রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করে দেন।
সূত্র আরও জানায়, এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি’র সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে এই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৬ বছর পর লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের এ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল।
পরে ২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া অভিযোগপত্রের ওপর হবিগঞ্জ জুডিসিয়াল আদালতে আবারও নারাজি দেন। এতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপ-নথির মাধ্যমে নারাজির আবেদন সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলা ফের তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন, যাতে নতুন ১১ জনসহ মোট ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেন– সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। এর আগের চার্জশিটের আসামিরা হলেন– ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহ।
২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে সেখানেই বিচারকাজ চলে, বর্তমানে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলার ৪৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আর বিস্ফোরক মামলাটি হবিগঞ্জ আদালতে রয়েছে।
কিবরিয়ার স্বজনরা জানান, বর্তমান সরকারের আমলে বিচার না হলে মামলা দু’টির বিচার হবে কিনা, সন্দেহ আছে।
নিহত সিদ্দিক আলীর ছেলে কদ্দুছ মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ ১৩ বছরে আমার বাবা হত্যার বিচার হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে বিচার না হলে ভবিষ্যতে বিচার হবে কিনা, সন্দেহ।’
নিহত আব্দুর রহিমের স্ত্রী আছিয়া খাতুন বলেন, ‘শুধু শুনানি আর সাক্ষ্যগ্রহণ হয় কিন্তু বিচার হয় না। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের রায় কবে হবে জানি না। এ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’ তার মেয়েও একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও গ্রেনেড হামলায় আহত মো. আবু জাহির বলেন, ‘আশা করি, বর্তমান সরকারের আমলেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হবে এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।’
মামলার বাদী হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ খান বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আশা করি শিগগিরই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হবে।’
সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, পাবলিক প্রসিকিউটর কিশোর কুমার কর বলেন, ‘আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন রয়েছে। এ মামলায় মোট ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। মোট আসামি ৩২ জনের মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এখন ২৯ জন আসামি রয়েছে। এর মধ্যে জামিনে আছে ১২ জন। পলাতক ৭ জন এবং কারাগারে আছে ১০ জন। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিচারিক কাজ সম্পন্ন হবে।’
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2DGBnAU
January 27, 2018 at 12:49PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন