রোনালদিনহোর আনুষ্ঠানিক ‘অবসর’


সর্বশেষ পেশাদার ম্যাচটি খেলেছেন সেই ২০১৫ সালে। এরপর কার্যত অবসরই নিয়ে ফেলেন রোনালদিনহো। বিদায়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই কেবল বাকি ছিল। অবশেষে সেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাও দিয়ে ফেললেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি। পেশাদার ক্যারিয়ারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলে পাকাপাকিভাবে নাম লেখালেন ‘সাবেক’এর খাতায়।

৩৭ বছর বয়সী রোনালদিনহো নিজ মুখে নয়, তার আনুষ্ঠানিক বিদায় ঘোষণার খবরটা বিশ্ববাসীকে দিয়েছেন তার ভাই অ্যাসিস। যিনি আবার তার এজেন্টও। ইউওএল স্পোর্তকে অ্যাস্টিস বলেছেন, ‘সে আর পেশাদার ফুটবল খেলতে চায় না। খেলবে না।

নিয়তির কি নিষ্ঠুর খেলা! রোনালদিনহোর মতো ফুটবলের একজন জাত শিল্পীকে কিনা বিদায়ের ঘোষণা দিতে হলো মাঠের বাইরে লেঅক-চক্ষুর আড়ালে কোনো এক তালাবদ্ধ অন্ধকার রুমে বসে! সেই ঘোষণাটা প্রচার করতে হলো অন্যকে। এতো বড় ফুটবলার সরাসরি মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারলেন না!

Presentacion de Ronaldinho.

নিয়তিকে দায়ী করা হলো বটে। তবে নিজের সঙ্গে এই ফুটবল-নিষ্ঠুরতার দায়টা একমাত্র তারই। একমাত্র নিজেকেই কাঠগড়ায় তুলতে পারবেন তিনি। অন্য কাউকে নয়। ঈশ্বর অমিয় প্রতিভা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাকে। সেই প্রতিভা রোনালদিনহো নষ্ট করেছেন খামখেয়ালিপনায়!

‘প্রতিভা অপচয়’ শব্দ যুগল ফুটবলে বহুল প্রচলিত। রোনালদিনহো যেন তার স্বার্থক চরিত্র। তার ক্ষেত্রেই বোধকরি এই ‍যুগল ব্যবহারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি! মদ, নারী আর নাইটক্লাবের নেশায় পড়ে নিজের প্রতিভার সঙ্গে কি নিষ্ঠুরতাই না করেছেন তিনি।

শিল্পী রোনালদিনহোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পে পরে আসছি। তার আগে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির উত্থানের গল্পটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভালো।

শিল্পী, ছোট্ট এই শব্দটার নিপূণতার সম্পর্ক গভীর। যুগে যুগে পায়ের মোহনীয় ছন্দে ফুটবলকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন যারা, রোনালদিনহো তাদেরই একজন। ফুটবলের জাত শিল্পী। অসাধারণ ড্রিবলিং, পায়ের শৈল্পিক কারুকার্যে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বোকা বানানোর দক্ষতা, দুর্দান্ত ফ্রি কিক, ডিফেন্স চেরা পাস, গোল করার দক্ষতা-কোনো কিছুতেই খামতি ছিল না রোনালদিহোর।

সদা হাস্যোজ্জ্বল রোনালদিনহো বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে পাকা জায়গা করে নেন ২০০২ বিশ্বকাপে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস সেই ফ্রি কিকের মধ্য দিয়ে। বক্সেরও অনেকটা উপরে সাইডলাইনের কাছাকাছি জায়গায় ফ্রি কিক পায় ব্রাজিল। দলে রবার্তো কার্লোসের মতো ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট থাকতেও ফ্রি কিকটি নেন তরুণ রোনালদিনহো।

EL JUGADOR BRASILEÑO, RONALDINHO, DEDICA UN GOL

এতো দূরে ফ্রি কিক পেলে সাধারণত বক্সের মধ্যে জটলা করে থাকা খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য করে ফ্রি কিক নেন সবাই। ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক ডেভিড সিমনও ভেবেছিলেন রোনালদিনহোও হয়তো তাই করবেন। তিনি তাই পোস্ট ছেড়ে কিছুটা উপরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

লক্ষ্য ছিল ভেসে আসা বল কেউ হেড করার আগেই দৌড়ে গিয়ে পাঞ্চ করে বিপদমুক্ত করবেন। কিন্তু তার সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে তরুণ রোনালদিনহো শট নেন সরাসরি গোলপোস্ট লক্ষ্য করে। বল সিমনের মাথার উপর দিয়ে বার ঘেষে ঢুকে যায় জালে। রোনালদিনহোর সেই গোলেই ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেমিতে উঠে যায় ব্রাজিল। পরে তো জিতে নেয় পঞ্চম বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপাই।

সাময়িক ভুলের জন্য ইংলিশরা অবশ্য সিমনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তবে বিশ্বফুটবল বোদ্ধারা মেতে উঠেন রোনালদিনহোর প্রশংসায়। আনকোরা রোনালদিনহো রাতারাতি বনে যান বিশ্ব তারকা। এরপর কেবলই তরতর করে উপরের দিকে উঠে যাওয়া। ২০০৩ সালে পিএসজি ছেড়ে বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর তো পুরো বিশ্বকেই বশ মানিয়ে ফেলেন।

ন্যু-ক্যাম্পে জাদুকরী ছন্দে বার্সেলোনাকে একের পর এক শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি তিনি নিজেও দুবার জিতে নেন ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। জায়গা করে নেন সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকায়। সবাইকে পেছনে ফেলে রোনালদিনহো সর্বকালের সেরা হয়ে উঠেন কিনা, সেই আলোচনাও তখন তৃঙ্গে।

ঠিক সেই সময় থেকেই অমার্জনীয় ‘ভুল’টা করে বসেন রোনালদিনহো। ফুটবলের চেয়েও বেশি প্রেমে পড়েন মদ, পরনারী আর নৈশ ক্লাবের। বার্সার তৎকালীন কোচ পেপ গার্দিওলার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ২০০৮ সালে পাড়ি জমান এসি মিলানে। ইতালিতে গিয়ে মদ, নৈশ ক্লাবের প্রতি প্রেম যেন আরও গাঢ় হয়! ফুটবল প্রতিভার অপচয় করে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেন নিজেকে।

২০১১ সালে মিলান ছেড়ে দেশ ব্রাজিলে ফিরেন বাজে এই নেশা থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু কোথায় কি! ব্রাজিলে ফিরে মদ, পরনারীর প্রতি আসক্তি আরও বারে। এক সময় প্রতিনিয়ত যিনি সংবাদ শিরোনাম হতেন ফুটবলীয় অর্জন দক্ষতায়, সেই রোনালদিনহো বারবারই শিরোনাম হন নৈশ ক্লাবে নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে। অনেকবারই প্রতিভা করেছেন, ওই ছাই-পাশ আর গিলবেন না, বাজে নেশায় আর জড়াবেন না। কিন্তু পারেননি। পারেননি বলেই ফুটবলপ্রেমীরা শিল্পী রোনালদিনহোর শৈল্পিক কারুকার্য দেখা থেকে বঞ্চিত। ফুটবলের ইতিহাস পায় প্রতিভা অপচয়ের স্বার্থক চরিত্র।

ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ৯৭টি ম্যাচ খেলেছেন। দেশকে একবার জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। লেঅকচক্ষুর বাইরে বসে বিদায়ের ঘোষণা দিলেও একটা বিদায়ী ম্যাচ তার প্রাপ্যই। তার ভাই জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে রোনালদিনহোর ‘বিদায়ী ম্যাচ’ আয়োজনের সম্ভাবনা নেই। তবে আগামী বিশ্বকাপের পরই ৩৭ বছর বয়সী রোনালদিনহোর সম্মানার্থে একটা বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করা হতে পারে বলে আশাবাদী অ্যাসিস।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2mHfD0T

January 17, 2018 at 03:34PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top