নব্বইয়ের দশকে বিবিসির সাংবাদিক হিসেবে আমি এক বড়সব রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার দল ও অন্য দলের মধ্যে মূল পার্থক্য কোন জায়গায়? তিনি আমার প্রশ্ন শুনে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন এবং খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপরে বললেন, ‘ওরা খারাপ আমরা ভাল। ওরা…একটা দেশের এজেন্ট, আমরা স্বাধীন।’ মোটামুটি এইভাবেই কথাবার্তা চলতে থাকে। অর্থাৎ বোঝা যায় অনেক নেতাকর্মীর কাছে এই দুটি দলের মৌলিক কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে না। তাহলে দুটা দল হয়েছে কী জন্য?
মোটামুটি মনে হয়, এই সংঘাতভিত্তিক রাজনীতির সময়কাল শেষ হয়ে আসছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি ও ব্যবসা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তার একটা করলে অন্যটার ওপর প্রভাব পড়ে। অতএব কেউ যদি পয়সা বানাতে চায় সে রাজনীতিতে প্রবেশ করতে পারে, কেউ যদি পয়সা রক্ষা করতে চায় সেও একই কাজটা করে। সেটাই যদি হয়, তাহলে মানুষে সংঘাতের রাজনীতি করে কেন নিজের পকেটের ভাড় কমাবে?
এই সমীকরণটা এখন খুব বড় আকারে এসছে, হতে পারে এটি একটি ক্রান্তিকালীন পর্যায়।
বিএনপি প্রধানের মামলাকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতিটা তৈরি হয়েছে, সেটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। রাজনৈতিক দলগুলো সবই বড়লোকের নিয়ন্ত্রিণ এবং ‘গরিব রাজনৈতিক নেতা’ একটি স্ববিরোধী কথা। আমাদের দেশের রাজনীতির কাঠামো এমনটাই যে, এর চর্চা করতে হলে খরচ করতে হয়। সে খরচ অর্জন করতে হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার সুযোগের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে যদি এই সুযোগ না থাকে তবে রাজনীতি চলবে কী করে?
১০ বছর পর এসে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর জন্য এটাই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সমাধান কিভাবে হবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে সংকটের বাস্তবতা অস্বীকার্য।
রাজনীতিতে কারা ক্ষমতায় থাকে?
সহজ হিসেবে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল ছিল পুরোপুরি বেসামরিক রাজনীতিবিদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ৭৫-এর পরে সামরিক রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা গ্রহণ করে। বিভিন্নভাবে তারা ক্ষমতায় ছিল ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। এরপরে স্বল্প কিছু দিন সামরিক-বেসামরিক চেহারা নিয়ে সরকার চলেছিল স্বল্প সময়। কিন্তু সেটি বেশিদিন টেকেনি।
এরশাদের মাধ্যমে সামরিক সরকারি শাসন পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই সমীকরণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে সামরিক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের হটিয়ে দেয় ১৯৯০ সালে। ওই বছরের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, এরশাদের পক্ষে সামরিক বাহিনী রাস্তাায় নামেনি। অর্থাৎ সামরিক- বেসামরিক শক্তিগুলো অনেক বেশি সচেতন ছিল। এক অর্থে সামরিক-বেসামরিক সমঝোতা ভিত্তিক যৌথশাসন প্রক্রিয়া চালু হয়।
১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল বেসামরিক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সামরিক রাজনীতিবিদদের সমঝোতার মাধ্যমে শাসন কার্য পরিচালনা। কিন্তু বেসামরিক রাজনীতিবিদদের অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে ২০০৬ সালের শেষের দিকে, যার ফলে আবার সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। লক্ষণীয় যে, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসন আলাদা ছিল।
এ কারণে, পূর্বেও সামরিক-বেসামরিক রাজনীতিবিদরা এক সঙ্গে শাসন পরিচালনা করত। কিন্তু ২০০৬-০৮ সালে সামরিক লোকরা বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মেলায়নি। সামরিকবাহিনী যাদের সহায়ক হিসেবে পেয়েছিল তারা হচ্ছে, বেসামরিক সমাজের একটি অংশ, যারা প্রধানত সুশীল হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ এরা রাজনৈতিক দল নয়, পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। এই সামরিক বাহিনী অবশ্য চেষ্টা করেছিল প্রফেসর ইউনুসের মাধ্যমে একটি দল করতে, কিন্তু এতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। বেসামরিক রাজনীতিবিদদের জেলে ঢুকিয়েও কিছু করা যায়নি। পরে সামরিক বাহিনী পিছু হটে।
২০০৮ সালের নির্বাচন প্রমান করে, সামরিক ও বেসামরিক রাজনৈতিবিদরা একে অন্যের শক্তি সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত হয়ে একটা দিকনির্দেশনা পায়। ২০০৮ সাল থেকে যে রাজনৈতিক ধারা চলছে সেটা প্রমান করে, এই সহঅবস্থানের নীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব। এই সহঅবস্থান ফর্মূলাতে কেউ একে অন্যের ঝাঁমেলা করে না। এ কারণে বর্তমান সরকারের জন্য সামরিক বাহিনী কোনো বিপদের কারণ বলে মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রধান দুই ক্ষমতাবান গোষ্ঠি এখন দ্বন্দ্বমুক্ত অবস্থানে রয়েছে।
এই মডেলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ছিটকে পড়েছে। যেহেতু দ্বন্দ্বভিত্তিক মডেলের পক্ষে খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া ও আরো কিছু নেতৃবৃন্দ। এটি নব্বই দশক পর্যন্ত হয়তো চলেছিল, কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতির যে মডেল অর্থাৎ সম্পর্কভিত্তিক পুঁজিবাদ, তার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না।
এরই মধ্যে দুই দলের ব্যবসায়ীরা একে অন্যের সঙ্গে বিভিন্ন সুসম্পর্ক স্থাপন করেছেন ও ব্যবসা করছেন। যদিও সব সময় তা প্রকাশ্যে নয়। তারা এটা আরো বাড়াতে চায়। কিন্তু দলের দ্বন্দ্বভিত্তিক অবস্থানের কারণে এটা বাড়াতে পারছে না। সেক্ষেত্রে দলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে একটা সমঝোতার পক্ষে উভয় দলের মধ্যে সমর্থন থাকার সম্ভবনাই বেশি।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি যদি খালেদা জিয়ার জেল হয়ে যায়, তিনি চাইবেন বিএনপি তার দ্বন্দ্ব মডেলভিত্তিক রাজনীতি করুক। এর প্রতি দলের ভেতরে সমর্থন থাকবে একটি অংশের। কিন্তু সবাই সমর্থন করবে এটা বলা যায় না। ২০০৬-০৮ সালের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, অনেকেই আছেন যারা সমঝোতার পক্ষে। রাজনৈতিক দল যখন বড়লোকের হাতে নিয়ন্ত্রিত তখন আদর্শ প্রধান হওয়াটা কোনোভাবেই বাস্তব নয়।
সে কারণে একটি অংশ ভেঙে আলাদা দল করার সম্ভাবনা দেখা দিতেই পারে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমীকরণ কী হবে বলা যাচ্ছে না। তবে আগামী নির্বাচনে বিএনপির একটি অংশের অংশগ্রহণ হলে এবং সেই অংশের প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকলে এই দ্বন্দ্বভিত্তিক মডেল চালু রাখা কঠিন হবে।
যেহেতু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শাসন ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক নীতির ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই, তাই তাদের পক্ষে একত্রিত হয়ে সমঝোতারভিত্তিতে রাজনীতি করা সম্ভব। যেমন করছে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ। সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্বটা এক সময় প্রধান ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব এখন প্রধান। তবে এটা আগামীতেও থাকবে এমনটা নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না।
আফসান চৌধুরী : সাংবাদিক ও গবেষক।
from Sylhet News | সুরমা টাইমস http://ift.tt/2E3oNMx
February 04, 2018 at 04:14PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন