ঢাকা, ২৬ মার্চ- জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে গান গেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক শরণার্থী ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সেইসব গান। সম্মুখ যুদ্ধে অংশ না নিয়েও যুদ্ধের পুরো সময় কাটিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সঙ্গে। জনপ্রিয় এই কণ্ঠযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ওই সময়ের স্মৃতি, কর্মকাণ্ড ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদকের মুখোমুখি হন তিনি। প্রতিবেদক : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে কোথায় ছিলেন? সেই সময়ের স্মৃতি... শাহীন সামাদ : যুদ্ধ শুরুর সময় ঢাকাতেই ছিলাম। আমাদের বাসা ছিল লালবাগে। সবাই বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে; কিন্তু সেটা কি- তা বোঝা যাচ্ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় সাধারণ মানুষের ওপর। গোটা রাজধানীতে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। হঠাৎ করেই অনেক গুলির শব্দ শুনতে পাই। সারারাত সেই শব্দ চলতে থাকে। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। ওই রাতে বাসার সবাই বসেছিলাম। কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে কয়েকদিন আগে থেকে বাসায় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। গুলি যাতে ঘরে আসতে না পারে এজন্য জানালাগুলোতে মোটা কাগজ দেওয়া হয়েছিল। সারা রাত গুলির প্রচণ্ড শব্দ পেলেও আমরা বুঝতে পারছিলাম না বাইরে আসলে কি হচ্ছে। মুক্তির গান এ শাহীন সামাদ পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ কারফিউ দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের জন্য যখন কারফিউ ভাঙল তখন পরিস্থিতি জানতে আমার ভাই বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। আম্মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না ভাইয়াকে বের হতে দিতে। তবু ভাইয়া এক প্রকার জোর করেই বের হলেন। ফিরে এসে ভাইয়া জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়, পলাশী, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শিক্ষকদের কোয়ার্টারে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে আছে। সব জায়গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা। এসব শোনার পরে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসলে প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছিল এরকম একটা হত্যাযজ্ঞ চালানোর। বাসার ছাদে উঠলাম বাইরের পরিস্থিতি দেখতে। আমাদের বাসার কাছাকাছি সলিমুল্লাহ হল ও পলাশী। ছাদে উঠে চারদিকে শুধু আগুন দেখতে পেলাম। দেখলাম, আশপাশের সবকিছু জ্বলছে আর ধোঁয়ায় চারদিক ভরে গেছে। প্রতিবেদক : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সম্পৃক্ত হওয়ার ঘটনা... শাহীন সামাদ : স্বাধীন বাংলা না, আমি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সঙ্গীত পরিচালক সমরদা (সমর দাস) যখন আমাদের ডাকলেন, তখন আমরা গিয়ে প্রথমে আটটা গান করে দিয়ে এসেছিলাম। বাইরের অনুষ্ঠানেরই বেশি চাপ ছিল আমাদের ওপর। আমাদের সংগঠনটা ভীষণ শক্তিশালী ছিল। সানজীদা খাতুন, কবি জাহিদুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, সৈয়দ হাসান ইমাম, মোস্তফা মনোয়ারসহ অনেক বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। একারণেই স্বাধীন বাংলা থেকে ডাক এসেছিল। প্রথমে আমরা যে আটটা গান করেছিলাম সেগুলো ক্রমাগত বেজেছে। পরে আমাদের আবার ডাকলো। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সোনার বাংলা... গাইলাম। পরে স্বাধীন বাংলার জন্য কলকাতার টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে আমরা ১৪টি গান করেছিলাম। তার মধ্যে যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না, চল যাই চল যাই, শিকল পরার ছল, করার ওই লৌহ কপাট, মানুষ হ মানুষ হ, পাক পশুদের মারতে হবে, শোনেন শোনেন ভাইসব, এই না বাংলাদেশের গান, জনতার সংগ্রাম, এসো মুক্তিদিনের সাথী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধ চলাকালে এসব গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনন্ত ২২ ঘণ্টা বেজেছে। প্রতিবেদক : যুদ্ধ শুরুর পর কতদিন এভাবে কেটেছে? শাহীন সামাদ : যুদ্ধ শুরু থেকে নয় মাস ওখনে ছিলাম। শুধু এক মাস আমরা ট্রাকে ট্রাকে ঘুরেছি, গান করেছি। ১ নভেম্বর রওনা হয়েছি। ১৫ দিন থেমে থেমে মুক্তাঞ্চলে গিয়েছি। একটার পর একটা জায়গা তখন মুক্তিযোদ্ধারা দখল করছিল। মুক্তাঞ্চল যেখানে হয়েছে সেখানে গিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের গান শুনিয়েছি, অনুপ্রেরণা দিয়েছি। এরকম একটা মুক্তাঞ্চলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন মেজর গিয়াস । তিনি আমাদের একবার বললেন, আপনার গান করে গেলেন, তারপরই ওরা যে অপারেশনে গেল, সেটাতে সফল হয়ে এসেছে। একাত্তরের একটি শরণার্থী ক্যাম্প গান সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করেছে। সেই সব গানের কথা, সুর সবার প্রাণের মধ্যে একটা ধাক্কা দিত। প্রতিবেদক : আপনার তো তখন বয়স কম। ঠিক ওই সময়ে মেয়েদের এরকম একটা কাজে যুক্ত হওয়া সাহসের ব্যাপার ছিল। কীভাবে অনুপ্রেরণা পেলেন? শাহীদ সামাদ : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮ বছর। আমি ছায়ানটে গান শিখতাম। তাই ওখান থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। এছাড়া ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাসনে কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম যুদ্ধ যদি হয়, তাহলে তো আমি বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করতে পারবো না। তবে আমরা কণ্ঠ আছে। এটাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া দেশে যখনই কোনো সংকট আসে তখন বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সোচ্চার হয়। আমাদের সংগঠনটাই ওরকম ছিল। যুদ্ধ শুরু পর সবসময়ই মনে হতো, আমাকে কিছু করতেই হবে। গানের ভেতর যে অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা আছে সেটাই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা মারা গেছেন ৬৬ সালে। তার আগেই তিনি আমাকে ছায়ানটে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরে মা আমাদের আগলে রেখেছিলেন। আম্মা জানতেন না আমি একা চলে যাব। আম্মাকে এক রকম কষ্ট দিয়েই কলকাতা চলে গিয়েছিলাম। ওখানে যাওয়ার পর খারাপ লাগত আম্মাকে আর দেখতে পারবো কিনা, ভাইবোদের সঙ্গে দেখা হবে কিনা -এসব ভেবে। অনেকে ভাইবোন, বাবা-মাকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি একাই আমাদের সংগঠনের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আম্মা যেমন জানতেন না আমি বেঁচে আছি কী না, তেমনি আমিও জানতাম না আমার পরিবারের খবর। ভীষণ কষ্টের একটা সময় ছিল । প্রতিবেদক : আপনার সঙ্গে আর কারা গিয়েছিলেন? শাহীদ সামাদ : আমার সঙ্গে বিপুল ভট্টাচার্য, মাহমুদুর রহমান বেনী, তারেক আলী, ডালিয়া নওশীন, শারমীন মোর্শেদ, লতা চৌধুরী, ইনামুল হক, স্বপন চৌধুরী, বেবী চৌধুরী, ওয়াহিদ ভাই, সানজিদা আপাসহ অনেকেই ছিলেন। সবাই আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট ছিল রূপান্তরের গান শিরোনামে। এটি সাজানো হয়েছিল মুক্তি ও সংগ্রামী চেতনার গান দিয়ে। আমরা যখন মঞ্চে গাইতাম আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড করতেন মোস্তফা মনোয়ার। আর ধারা বর্ণনা দিতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। প্রতিবেদক : আপনারা তো বিভিন্ন শরণার্থী এবং মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে গিয়ে গান শোনাতেন। তাদের উদ্দীপ্ত করতেন। এই অনুভূতিটা কেমন ছিল? শাহীদ সামাদ : অনুভূতিটা তখন যা ছিল এখনও তাই। এখনও যখন গানগুলো করি, মনে হয় সেই সময়ে চলে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সেই গান এখনও উদীপ্ত করে। অনেক শক্তিশালী সেই সব গান। একটা -দুইটা করে তো গান করতাম না আমরা। একেক দিন দুইটা তিনটা করে অনুষ্ঠান থাকত। আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল টাকা জোগাড় আর মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সাহায্য করা। গান গেয়ে যে সম্মানী পেতাম তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য হাঁড়িপাতিল,খাবার,পানি,কম্বলসহ নানা জিনিস কেনা হতো। অনেক খাটুনি করতে হতো। তারপরও অসম্ভব ভালো লাগত তাদের সাহায্য করতে পেরে। প্রতিবেদক : যে প্রত্যয় নিয়ে একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তা কতটা পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন? শাহীন সামাদ : দেশ এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বেশি ভালো লাগে যখন নারীদের দেখি। মেয়েদের জীবনে এখন অনেক স্বাধীনতা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা নাম করছে। গার্মেন্টেসেও মেয়েরা কাজ করছে। কত শিল্প কারখানা হয়েছে। তবে ভালোমন্দ মিলিয়েই সব কিছু। আমরা যদি দেশকে আরও বেশি ভালোবাসতাম তাহলে হয়তো আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক বুদ্ধিমান। তারা ইন্টারনেট থেকে অনেক কিছু জানতে পারে, সেই সময়ের ঘটনা জানতে পারে। আমাদের উচিত তাদের সেই গাইডলাইন দেওয়া। তবে যে গান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল সেই গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কোন ইনস্টিটিউট সেগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়নি। সরকারি বা বেসরকারিভাবে এগুলো সংরক্ষণ হয়নি। এগুলো যদি সংগৃহীত হতো এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যেত, তাহলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা গানগুলো থেকে অনেক অনুপ্রেরণা ও শক্তি নিতে পারত। প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে আপনার পরামর্শ কী? শাহীদ সামাদ : আরও বেশি প্রচার, প্রসার দরকার। এখন তো অনেক গণমাধ্যম। সেগুলো যদি দেশ নিয়ে অনুষ্ঠান করে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান বা একাত্তরের গান নিয়মিত প্রচার করে তাহলে এই প্রজন্ম অনেক উৎসাহিত হবে। সেই সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এমন সব অনুষ্ঠান করা দরকার যেখানে তাদের চিন্তা, ভাবনা সম্পৃক্ত করা যায়। প্রতিবেদক : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শাহীন সামাদ : আপনাকেও ধন্যবাদ। সূত্র: সমকাল আর/১০:১৪/২৬ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2GgT1g9
March 27, 2018 at 05:05AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন