আজ আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ১৪ বছর পূর্তি……..

নিজস্ব প্রতিবেদক::  সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) দরগাহ প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০০৪ সালের এই দিনে তিনি দরগাহ চত্বরে গ্রেনেড হামলার শিকার হন। হামলাকারীদের গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক আবুল হোসেনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। নিহত হন পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ তিনজন। এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। আতংক ছড়িয়ে পড়েছিল সিলেটসহ সারা দেশে। এ ঘটনায় হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরিফ শাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। ভয়াবহ দিনটির কথা মনে হলে সিলেটের মানুষ এখনো আঁতকে উঠেন। চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই বীভৎসতা। রক্তস্্েরাতের সেই ভয়ংকর স্মৃতি আজও তাদের তাড়া করে।

সেদিন যা ঘটেছিল :-

ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে জন্মভূমি বাংলাদেশে দায়িত্ব গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে সিলেটে এসে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন আনোয়ার চৌধুরী। ২০০৪ সালের ১৫ মে তিনি ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ২১ মে শুক্রবার সিলেটে ছুটে এসেছিলেন। এদিন পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের পাটলি ইউনিয়নের প্রভাকরপুর গ্রামের বাড়ির পাশাপাশি সিলেটের বিভিন্ন জায়গা সফরের কথা ছিল আনোয়ার চৌধুরীর। এর মধ্যে শুক্রবার বলে তার ইচ্ছে অনুযায়ী কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে শাহজালাল (র.) দরগাহ মসজিদে মাজারে জুমার নামাজ আদায় করেন তিনি। দুপুর ১২টার দিকে তিনি মাজারে পৌঁছলে সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল হোসেনসহ মাজারের খাদেম ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানান। প্রথমে হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারত করে আনোয়ার চৌধুরী মাজার সংলগ্ন দরগাহ মসজিদেই সবার সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করেন। বৃহত্তর সিলেটের একজন ব্রিটিশ হাইকমিশনার হয়ে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও তাকে নিয়ে ব্যাপক আনন্দ ও উচ্ছ্বাস ছিল। সেদিন অনেকে তাকে দেখার জন্য মাজার এলাকায় ভিড় করেন। জুমার নামাজ শেষে আনোয়ার চৌধুরী মানুষের ভিড় ঢেলে সমবেত লোকজনের সাথে করমর্দন করে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকেন। জুমার নামাজ শেষে প্রধান ফটকের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রচ- বিস্ফোরণ শব্দে কেঁপে ওঠে দরগাহ এলাকা। এতে আনোয়ার চৌধুরীসহ অনেকে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আতঙ্কিত মানুষেরা দিগি¦দিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ কর্মকর্তা ও পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দু’জন নিহত হন। আহতদের অনেকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। স্পিøন্টার নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন অনেকে। সেদিন হামলার মূল টার্গেট ছিলেন আনোয়ার চৌধুরী। তাকে লক্ষ্য করেই হামলা চালানো হয়েছিল। জঙ্গিদের ছোঁড়া গ্রেনেড তার সামনে বিস্ফোরিত হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। তবে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান পুলিশের এএসআই কামাল উদ্দিন। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান দিনমজুর হাবিবুর রহমান হাবিল মিয়া ও এমসি কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী দরগাগেইট এলাকার বাসিন্দা রুবেল আহমদ। সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল হোসেন, আনোয়ার চৌধুরীর আত্মীয় সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মরহুম আবদুল হাই খান, সাংবাদিক মুহিবুর রহমান, ফটো সাংবাদিক ছুরত আলীসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন।

প্রথমে অন্যদের সঙ্গে আনোয়ার চৌধুরীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়। দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই গ্রেনেড হামলা মামলায় দ-প্রাপ্ত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।

মামলা দায়ের অত:পর জঙ্গিদের ফাঁসি ॥

ঘটনার দিনই অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা করে সিলেট কোতোয়ালি থানার পুলিশ। মামলার তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই মুফতি হান্নানসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালের নাম অন্তর্ভুক্ত করে অভিযোগ গঠন করা হয়।

বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনকে মৃত্যুদ-াদেশ দেন। এ ছাড়া মামলার অন্য দুই আসামি মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ও মুফতি মঈনউদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেন।

নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদ-াদেশ অনুমোদন করতে প্রয়োজনীয় নথি হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি ২০০৯ সালে আসামিরা জেল আপিলও করেন। প্রায় সাত বছর পর ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি এ মামলায় হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। পরে বিচারিক আদালতের দ- বহাল রেখে ১১ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই বছর ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।

পরে একই বছর ১৩ জুলাই হাইকোর্টে দেওয়া মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেন মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল। তাদের সঙ্গে আদালত মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অপর আসামি দেলোয়ার হোসেন রিপনের পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত করে একই সঙ্গে তিনজনের আপিল শুনেন আপিল বিভাগ। ১৫ নভেম্বর এই মামলায় হাইকোর্টে মৃত্যুদ- বহাল থাকা মুফতি হান্নানসহ তিন আসামির করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন আপিল বিভাগ। সেই আপিল শুনানি শুরু হয় ৩০ নভেম্বর। শুনানি শেষ হয় ৬ ডিসেম্বর। শুনানি শেষে ৭ ডিসেম্বর তিনজনের মৃত্যুদ-ই বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগের ৬৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি। আপিল বিভাগের এ রায় পাওয়ার পর আসামিদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন বিচারিক আদালত। ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছালে এ পরোয়ানা মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের পড়ে শোনানো হয়।

এরপর সর্বশেষ আইনী সুযোগ হিসেবে ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিলে বহাল থাকা মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করেন মুফতি হান্নানসহ তিন আসামি। শুনানি শেষে ১৯ মার্চ ওই রিভিউ খারিজ করে দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। এরপর ২১ মার্চ ওই রিভিউ আবেদন খারিজের রায় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। এরপর প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন দ-প্রাপ্তরা। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাদের আবেদন খারিজ করে দেন। ১২ এপ্রিল বুধবার রাত ১০ টা ১ মিনিটে কাশিমপুর কারাগারে মুফতি হান্নান ও সাহেদুল আলম ওরফে বিপুল এবং সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে দেলওয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কাশিমপুরে সাকু ও রাজু এবং সিলেট কারাগারে ফারুক জল্লাদ এই ফাঁসি কার্যকর করেন। কাশিমপুর কারা কমপ্লেক্সের ইমাম মাওলানা হেলাল উদ্দিন হান্নান ও বিপুলকে তওবা পড়ান। আর রিপনকে তওবা পড়ান সিলেটের আবু তোরাব জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মুফতি বেলাল উদ্দিন।

আনোয়ার চৌধুরীর পরিচিতি ॥ আনোয়ার চৌধুরী ১৯৫৯ সালের ১৫ জুন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলি ইউনিয়নের প্রভাকরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও ১০ বছর বয়সে তিনি বাবা মায়ের সাথে লন্ডনে চলে যান। আনোয়ার চৌধুরী একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক হলেও তার লেখাপড়া ছিল ইঞ্জিনিযারিং-এ। তিনি সলফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেক্ট্রনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিএসসি পাশ করেন। পরে তিনি ডুরহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে এমবিএ করেন। সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের পূর্বে তিনি র‌্যাফের হয়ে কাজ করেন। তার কর্মজীবন শুরু হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি থেকে। সেখানে তিনি ২০০০ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তবে, ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও পরে ২০০৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আনোয়ার চৌধুরী মোমেনা চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন সন্তান রয়েছে।

এর আগে আনোয়ার চৌধুরী ২০০৩ সালে ব্রিটিশ ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসে (এফসিও) যোগদান করেন। তিনি প্রাইভেট সেক্টর, দ্য রয়েল এয়ারফোর্স, মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স এবং ক্যাবিনেট অফিসের ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনোয়ার চৌধুরী। ঢাকায় দায়িত্ব পালন শেষে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউশনের ডিরেক্টর হিসেবে তিনি আবারও এফসিওতে ফেরত আসেন। পরে ওই দপ্তরের আরও কয়েকটি পদে কাজ করেন তিনি। ২০১৩ সালে তাকে রাষ্ট্রদূত করে পেরুতে পাঠানো হয়।

এদিকে, চলতি বছরের ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে ব্রিটেনের কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্নর হিসেবে শপথ নিয়েছেন বাংলাদেশের কৃতি সন্তান, ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী। এদিন তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনায় বরণ করে নেয় দ্বীপবাসী। গত বছর যুক্তরাজ্যের ওভারসিজ টেরিটরি কেইম্যান আইল্যান্ডের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।

তিনি কেবল প্রথম বাংলাদেশিই নন, প্রথম এশিয়ান হিসেবেই কোনো ব্রিটিশ নাগরিক যিনি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত কোনো আইল্যান্ডের প্রধান বা গর্ভনর হিসেবে নিয়োগ পেলেন। প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী, গভর্নর এ দ্বীপের প্রধান। ব্রিটেন থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান বা গর্ভনর নিয়োগ দেওয়া হয় হোয়াইট হল থেকে।



from Sylhet News | সুরমা টাইমস https://ift.tt/2GCPs38

May 21, 2018 at 07:03PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top