মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: ‘অত দাম কিতার লাগী বা। ফুরির বাড়ি ইফতারি না দিলে ওইত নায়, দাম হইলেও কিনতাম হুইব। আগেতো ঘরের বেটিনতে বাড়িত বানাইয়া দিলাইতা অকনোর বেটিনটে ইতা বানাইন না এর লাগী বাজার তনে অত দাম দি কিইনা ফুরির বাড়ি ইফতারি দেওয়া লাগে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ইফতারি না দিলে নয়, তাই দাম হলেও কিনতে হবে। আগে ঘরের মেয়েরা এই ইফতারি বানিয়ে দিত, এখন বানায় না এ কারণে বাজার থেকে এত দামে কেনা লাগে।
সোমবার দুপুরে বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের সিলেট অঞ্চলের নিয়ম অনুযায়ী ফুরির বাড়ি (মেয়ের শ্বশুর বাড়ি) নিয়ে যাওয়ার জন্য ইফতারি কিনতে আসা এক বৃদ্ধ পিতা এভাবেই সিলেটের আঞ্চলিক বাসায় বিক্রেতার সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন। অতিথি আপ্যায়নে সিলেটের মানুষের রয়েছে দারুণ সুখ্যাতি। তেমনি অতিথি হিসেবে কারও বাড়িতে যাবার সময় নানা প্রকার মৌসুমী ফল-ফলারি, মিষ্টি-মিঠাই বা পছন্দমত যে কোনো জিনিস সঙ্গে করে নেয়ার রেওয়াজও এখানে অনেক পুরনো। বিশেষ করে সিলেটের আপন ঐতিহ্য-রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ। সিলেটি ভাষায় এটাকে ‘ফুরির বাড়ি ইফতারি’ বলা হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিলেট অঞ্চল থেকে ফুরির বাড়ির ইফতারি দেয়ার রেওয়াজে পরিবর্তন এসেছে। আগে দিনে রমজান মাস এলে বাড়িতে বানানো ইফতারি থালা সাজিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতেন তার অভিভাবকরা। কিন্তু আগের মতো বাড়িতে বানানো ইফতারি আর মেয়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় না। এখন সে স্থান দখল করেছে হাট-বাজারে বানানো নানা রং চংয়ের ইফতারি।
উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সিলেট অঞ্চলে নতুন জামাই বাড়িতে তিন দফায় ইফতারি দেয়া হয়। প্রথম দফায় প্রথম রমজানে দিতে হয়। ওই দিন শুধু ঘরে তৈরি করা পিঠা-পায়েসসহ ফল-ফলারি নিয়ে যাওয়া হয়। ইফতারি আইটেমের মধ্যে রয়েছে-হান্দেশ, ছই পিঠা, চিতল পিঠা, রুটি পিঠা, ভাপা পিঠা, ঢুপি পিঠা, খুদি পিঠা, ঝুরি পিঠা, পানি পিঠা, চুংগা পিঠা, তালের পিঠা, পাড়া পিঠা, নুনের ডোবা, নুনগরা এবং নারিকেল সমেত তৈরি পবসহ আরো নানা ধরনের পিঠা। এছাড়াও খেজুর, আপেল, আম তো থাকেই। ইফতার সামগ্রীর মধ্যে মিষ্টি, জিলাপী, নিমকী, খাজা, আমির্তি, বাখরখানি ছাড়াও মৌসুমী ও দেশি-বিদেশি ফল, চানা, পিঁয়াজু, পোলাও, চপ, বেগুনী ও শাকের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বড়া ইত্যাদি দিয়ে সাজানো খাঞ্চা (বড় থাল) নেয়া হয়। আবার কোথাও মেয়ের জামাই, মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ীর জন্য আলাদা করে থালা সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন বাজারের তৈরি ইফতারি সাজিয়ে নেয়া হয়। রোজার শেষ দিকে আবারও যান কনের দাদা-নানা, বাবা-চাচা, ভাই অথবা নিকট আত্মীয় যে কেউ। এ সময় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সকলকে ঈদে বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দেয়া হয়। মেয়ের বাড়ি থেকে যে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হয় তা বাড়ির এবং পাড়া-পড়শীর ঘরে ঘরে বিলি করা হয়। ইফতারের পর মেজবানের ভূরিভোজের জন্য তাৎক্ষণিক ভাবে জবাই করা হয় ঘরে পোষা বড় মোরগ বা মুরগী। অনেকে আবার গরু জবাই করে। আগেকার দিনে নিজের ঘরে পোষা মুরগী না থাকলে বা ধরতে ব্যর্থ হলে পার্শ্ববর্তী কোন ঘর থেকে মুরগী কিনে বা ধার করে আনা হতো ‘মান-ইজ্জত রক্ষার’ জন্য। সেই আগেকার দিনের রেওয়াজ এখনো ঠিকে আছে সিলেট অঞ্চলে। অন্যদিকে স্বামী বা শ্বশুর-শ্বাশুরী ‘জল্লাদ’ বা ‘খিটখিটে মেজাজে’র হলে নয়া বউ ভিন্ন মাধ্যমে গোপনে বাপের বাড়ীতে সংবাদ প্রেরণ করেন যে-আর কিছু না হোক ইফতার সামগ্রী উন্নত ও পরিমাণে যেন বেশি হয়। কোন কোন বদ মেজাজী পেটুক বা লোভী বর কিংবা বরের পিতাকে ইফতার সামগ্রী একটু কম বা কিছুটা নিম্নমানের কারনে ছেলের শশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া করতেও দেখা যায়। আধুনিকতার এই যুগেও অনেকে নতুন আত্মীয়ের বাড়ির ইফতার খাবার জন্য সুদূর প্রবাস থেকেও দেশে আসেন। আবার অনেকের মেয়ে জামাইর সঙ্গে বিদেশে থাকলেও লোক মারফত জামাইর দেশের বাড়িতে ইফতারির জন্য টাকা প্রেরণ অথবা ইফতারি প্রদান করতে শুনা যায়।
from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ https://ift.tt/2IDOfKW
May 21, 2018 at 05:52PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.