ঢাকা, ২১ জুন- বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট বিশাল এক লাফ দিয়েছে এ মাসের শুরুর দিকে এশিয়া কাপ জয়ের অভূতপূর্ব সাফল্যে। বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেটাররা জুনের প্রথম দিকে মালয়েশিয়া সফরে গিয়েছিল ছয় জাতির এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে, তবে আশ্চর্যভাবে, মেয়েরা শিরোপা উঁচিয়ে শেষ করে মিশন। নিজেদের প্রথম ম্যাচে হারলেও পরে টানা পাঁচ জয়ে শিরোপা উদাযপন করে তারা। ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ফাইনালে ৩ উইকেটে হারিয়ে বাধভাঙা উল্লাসে মাতে লাল-সবুজধারী মেয়েরা। এই ঐতিহাসিক সাফল্যে পুরো দেশের নজর বদলে পড়ে মহিলা ক্রিকেটের ওপর, যেখানে বিসিবির কাঁধে আসে অনেক বড় দায়িত্ব। যদিও এই মনোযোগ সবচেয়ে দ্রুত পড়ে ছেলেদের ক্রিকেট ও মেয়েদের ক্রিকেটের পার্থক্য খোঁজার দিকে। সঙ্গে কিছুটা হলেও বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, মেয়েদের ক্রিকেটের তুলনায় ছেলেরা অনেক বেশি সুবিধা পাওয়ায়। মূল আলোচনায় আসে মেয়েদের বেতন কাঠামো, অনুশীলন সুবিধা এবং উইমেন্স উইংয়ের প্রচেষ্টার বিষয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে এ প্রতিবেদক হাজির হয়েছিল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও উইমেন্স ক্রিকেট উইংয়ের চেয়ারম্যান শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের কাছে। যেখানে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে বোর্ড আসলে মেয়েদের জন্য কী করছে। মেয়েদের ক্রিকেটের উন্নয়নে প্রচেষ্টা বিসিবি বিশ্বাস করে, এশিয়া কাপের সাফল্য এসেছে বোর্ড ও ক্রিকেটারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। বিসিবি প্রধান নাজমুল জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়েদের ক্রিকেটের দিকে নজর দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন, মেয়েদের নিয়ে বিশাল সম্ভাবনা আছে। নাজমুল জানিয়েছেন, জাতীয় দলের মেয়েরা বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না, যে কারণে র্যাংকিংসহ অন্য বিষয়ে ভালো জায়গায় নেই। এত বাধা স্বত্বেও বিসিবির দাবি, মেয়েদের ক্রিকেটের বড় প্রতিযোগিতায় নিজেদের সেরা বের করে আনতে ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বড় মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করতে তারা যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের মহিলা দল খেলেছে নয়টি দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ, যার ছয়টিই হয়েছে চলতি বোর্ডের অধীনে। মেয়েরা এই সময়ে অংশ নিয়েছে দুটি বিশ্ব টি-টোয়েন্টি ও আরেকটি আইসিসির ইভেন্টে, খেলেছে এশিয়া কাপ এবং রুপা জিতেছে ২০১০ সালের এশিয়ান গেমসে। জাতীয় দলের সাপোর্ট স্টাফের কথা বললে, মহিলা দল সবসময়ই স্থানীয় কোচের অধীনে খেলেছে। তবে আমরা বোর্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদেশি কোচের বিষয়ে নজর দেই। আমরা শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও অন্য জায়গা থেকে কোচ এনেছি। তবে চ্যালেঞ্জ ছিল, মেয়েরা ঠিকঠাক যোগাযোগ করতে পারছিল না। এজন্য আমরা ভাবলাম ভারত থেকে কোচ আনার, যেখানে পেয়েছি অঞ্জু জেইনের মতো কোচ, যার ভারতে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে। ফিজিওর ব্যাপারে দুশ্চিন্তা ছিল, মেয়েরা পুরুষ ফিজিওতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, তাই আমরা ভারত থেকে এনেছি অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করা মহিলা ফিজিওকে।- বলেছেন নাজমুল। বিসিবি সভাপতি জানিয়েছেন, এশিয়া কাপের সাফল্যের পর দল অনেক বেশি অনুপ্রাণিত, আর বোর্ড সাফল্যের এই ধারাটা ধরে রাখতে চায়। বোর্ড এখন ব্যস্ত মেয়েদের আন্তর্জাতিক ব্যস্ত সূচি নিয়ে। এই সপ্তাহেই মেয়েরা যাচ্ছে আয়ারল্যান্ড সফরে, এরপর নেদারল্যান্ডসে খেলবে বিশ্ব টি-টোয়েন্টির বাছাই পর্ব। এটা ঠিক নয় যে, আমরা আমাদের মেয়েদের নিয়ে ভাবছি না। আমরা চেষ্টা করছি। তবে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের দেশে মেয়েদের ক্রিকেটের যে কাঠামো, তাতে অনেকটা সময় লাগবে। আমরা অনেক স্কুলে গিয়ে উৎসাহিত করছি যাতে ছোট মেয়েরা খেলার সঙ্গে যোগ হয়, তবে কষ্ট হলেও সত্যি কোনও সাড়া পাচ্ছি না। ঢাকা ছাড়া দেশের আর কোথাও মেয়েদের জন্য কোনও প্রতিযোগিতা নেই। আমরা কয়েকজন মেয়েকে পেয়েছি, যারা খুলনা ও রংপুর থেকে এসেছে।- বলেছেন নাজমুল। এশিয়া কাপের জয় আমাদের জন্য বিশাল বড় প্লাস পয়েন্ট, কারণ আমি বিশ্বাস করি এই সাফল্য খেলাটির প্রতি মেয়েদের আগ্রহ জন্মাবে। আমরা ইতিমধ্যে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন স্তরে প্রতিযোগিতা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি এবং উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি এই কাঠামোতে অন্তর্ভূক্ত করতে। শুধু এই মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে মেয়েদের ভালো দল পেতে পারি।- যোগ করেছেন বিসিবি প্রধান। তাদের আয় আসলে কত? মেয়েদের ক্রিকেটের বেতন কাঠামো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। পুরুষ দল ও মহিলা দলের মাসিক বেতন ও ম্যাচ ফির পার্থক্য অনেক, তবে এটারও ব্যাখ্যা আছে বিসিবি প্রধান নাজমুলের কাছে। মেয়েদের ম্যাচ ফির বিষয়টি সামনে আসে গত বছর, যখন জাতীয় ক্রিকেট লিগে ৬০০ টাকা ম্যাচ ফির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল ব্যাপক। নাজমুলের মতে, এই তুলনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে কখনোই করা যাবে না। ২০০৮ সালে বিসিবি প্রথমবার মহিলা ক্রিকেটারদের কেন্দ্রীয় চুক্তির সঙ্গে পরিচয় করায়। এর দুই বছর পর গঠিত হয় উইমেন্স উইং। বছর গড়ানোর সঙ্গে এই কাঠামোর উন্নতি হয়েছে নতুন পাঁচটি আলাদা গ্রেডে- এ, বি, সি, ডি ও ই। ২০০৮ সালের আগে বিসিবি কখনোই মহিলা ক্রিকেটারদের বেতন দেয়নি। উইমেন্স উইংয়ের জন্মের সঙ্গে বেতন কাঠামোর বিষয়টিও সামনে আসে, যদিও সেটা কার্যকর ছিল না। মাত্র তিন ক্রিকেটারকে বেতন কাঠামোর মধ্যে এনে বাকি ক্রিকেটারদের উৎসাহিত করা হয়। ওই সময়ে ক্রিকেটারদের কোনও রকম পেশাদারি তথ্য ছিল না। ওই সময় মেয়েদের ক্রিকেট ছিল উপলক্ষ কিংবা অবকাশ যাপনের ক্রিকেট।- প্রতিবেদককে বলেছেন নাজমুল। নাজমুল বলেছেন, ২০১৪ সালে বিসিবি উইমেন্স উইং ঢেলে সাজানো হয়েছে এখনকার কমিটি দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর। আমরা এটাকে আরও পেশাদারিত্ব ও কাঠামোগত করার উদ্যোগ নেই। সব ক্যাটাগরিতে বেতন ১০ হাজার টাকা করে বাড়ানো হয় এবং আরও বেশি গ্রেড আনা হয় বেতন কাঠামোতে, যা এখন গ্রেড এ থেকে গ্রেড ই পর্যন্ত। এটা করার পথে আমরা খেলেয়াড়দের তথ্য বের করে এনেছি, তাদের একটি সিস্টেমের মধ্যে এনেছি, যা আমাদের একটি দল তৈরি করতে সাহায্য করেছে। সত্যি বলতে এখনও অনেক সংকটের মধ্যে মহিলা ক্রিকেট এবং খুব বেশি খেলোয়াড় আসছে না। ছেলেদের ক্রিকেটে প্রতিভা খুঁজতে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিযোগিতা রয়েছে- স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট ও অন্যান্য ঘরোয়া লিগ। তবে মেয়েদের ক্রিকেটে এখনও কোনও কাঠামো নেই। মেয়েদের জন্য আছে শুধু ঢাকা ছিল, তাও সেটার মানও খুব এটা নেই। একমাত্র আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ভালো দল গঠন করে এবং ফল সবসময় তাদের পক্ষেই যায়। অন্য দলগুলো প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতেই পারে না।- বলেছেন নাজমুল। বেতন ছাড়াও মহিলা ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক সিরিজ ও টুর্নামেন্ট থেকে আয় করে থাকেন ম্যাচ ফি, দৈনন্দিন ভাতা ও ট্যুর ফির মাধ্যমে। প্রায় ৫০ জন ক্রিকেটার আছেন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, যারা শুধু বোর্ড থেকে বছরে আয় করতে পারেন ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে ৭ লাখ টাকা। ক্রিকেটারদের আরেকটি ভালো আয়ের উৎস প্রিমিয়ার ডিভিশন, যেখানে ক্লাবগুলো এখন অনেক বেশি খরচ করতে শুরু করেছে। ৩ লাখ টাকা থেকে এখন দলগুলো ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করছে, যাতে সেরা ক্রিকেটাররা টুর্নামেন্ট থেকে ৪ লাখ টাকাও আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত বছর চালু হওয়া প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগও ক্রিকেটারদের ভালো আয়ের প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছে। এটা সত্যি ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি আয় করে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, এটা বিশ্বের সবখানেই একই। বিরাট কোহলির আয় ৭ কোটি রুপি, যা তাদের মহিলা দলের অধিনায়কের চেয়ে অনেক বেশি, বছরে সে হয়তো ৫০ লাখ রুপি আয় করে। এই বিষয়টি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা অন্য যে কোনও জায়গায় একই। ছেলেরা কয়েকদিন আগে খুব বাজে খেলেছে (আফগানিস্তানের বিপক্ষে), তবে তার মানে এই নয় যে তামিম (ইকবাল), মুশফিকুর (রহিম), সাকিব (আল হাসান) কিংবা মাশরাফিকে (বিন মুর্তজা) তুলনায় দাঁড় করানো হবে মহিলা ক্রিকেটারদের সঙ্গে। আমরা কোনও মহিলা ক্রিকেটারের সঙ্গে উঁচু পর্যায়ের কোনও পুরুষ খেলোয়াড়দের তুলনা করতে পারি না। এটা করাটা বড় ভুল।- বিসিবি প্রধানের ব্যাখ্যা। মেয়েদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এশিয়া কাপ জয়ের পথে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভারতের (দুইবার) বিপক্ষে জয় বিসিবির জন্য বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশে মেয়েদের ক্রিকেটেকে উজ্জীবিত করতে। বিসিবির পরিচালক নাদেল জানিয়েছেন, বোর্ডের প্রধান নজর আকর্ষণী ও উৎসাহী মেয়েদের নিয়ে পাইপলাইন সমৃদ্ধ করার দিকে। বিসিবি বাৎসরিক ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে মেয়েদের ক্রিকেটের জন্য এবং পরিকল্পনা করছে স্কুল ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের মাধ্যমে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আবিষ্কার করার। তৃণমূল পর্যায়ের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও জানিয়েছেন নাদেল। প্রাথমিকভাবে আমরা এই বছর কয়েকটি বিভাগে কাজ শুরু করব। এটা ছাড়াও আমরা জাতীয় ক্রিকেটারদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার উন্নতির জন্য নিয়মিত ক্যাম্প রাখার পরিকল্পনা করেছি, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভেন্যুর ব্যবস্থা রেখে।- প্রতিবেদককে বলেছেন নাদেল। এটা ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর যে কোনও জায়াগা হতে পারে কিংবা অন্য কোথাও হতে পারে। এর মাধ্যমে তাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যেতে হবে না। নির্দিষ্ট ভেন্যুতে ক্যাম্প হলে তাদের মধ্যে বিশেষ একটা অনুভূতি কাজ করবে এবং তারা তাদের প্রস্তুতির দিকে নজর দিতে পারবে।- যোগ করেছেন বিসিবি পরিচালক। সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন আর/১৭:১৪/২১ জুন
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2MMcbhI
June 22, 2018 at 05:42AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন