আবুধাবি, ০৩ জুন- প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট দিকে পেয়ে গেলাম স্থানটি। মজলিশের গেটে অভ্যর্থনার জন্য তখনো উপহারের উপাদানগুলো সুসজ্জিত ব্যাগে ভরা হচ্ছিল। ভেতরে গিয়ে দেখি বসার জন্য গোলটেবিল। একেকটি টেবিলের চারপাশে ১০টি করে চেয়ার। টেবিলের সংখ্যা ২০। বিশুদ্ধ একটি পরিবেশ! বিদেশি কূটনীতিকরা আসছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান তাঁদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তারা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কথা বলছি। এরই একটি হলো লিউয়া মজলিশ। এখানেই বাংলাদেশ দূতাবাস ইফতারের আয়োজন করেছে। গত রোববার (২৭ মে) এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন আমিরাতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশি কূটনীতিক ও বাঙালি কমিউনিটির সম্ভ্রান্ত জনেরা। এসেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা। এসেছেন বাংলাদেশ সমিতি, আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলের কর্মকর্তা ও শিক্ষকেরা। এসেছেন সামাজিক সংগঠনের নেতা ও সংগঠকেরা। তাঁরা বসে পড়েছেন টেবিল ঘিরে। রোজাদারের জন্য ইফতার এক অন্যরকম আনন্দের মুহূর্ত। সারা দিনের অনাহার আর কর্মব্যস্ত শরীর এ সময় ফুরফুরে হয়ে ওঠে। প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে দেহ ও মন। সামনে নানারকম খাবারের আইটেম। সঙ্গে দইয়ের পানীয় কিংবা ফলের শরবত। যেন বেহেশতি আবহ। সবকিছু সামনে নিয়ে চলতে থাকে মুয়াজ্জিনের আজানের প্রতীক্ষা। কখন মিনারে ধ্বনিত হবে আল্লাহু আকবর। ফাঁকে ফাঁকে ঘড়ি দেখা আর মুখে দোয়া-দরুদ পড়া। রোজা পালনে ইফতারের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার সময়মতো ইফতার করার মধ্যেও রয়েছে অশেষ সওয়াব ও কল্যাণ। ইফতারে রয়েছে আল্লাহ ভীতি, নিষ্ঠা, সংযম ও প্রবৃত্তি দমনের অপূর্ব নিদর্শন। রোজাদারেরা তখন সবার কল্যাণ কামনা করছেন। আমি যে টেবিলটাকে সামনে রেখে বসেছি সেটা বাংলাদেশ স্কুলের। এভাবে বলছি এ জন্য, এখানে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বসেছেন। ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা বসলেও কিছুক্ষণ পরে তাঁদের পালাবদল হলো। তাঁরা আলাদা এক টেবিলের প্রতিনিধিত্ব করলেন। একইভাবে বাংলাদেশ সমিতিও দেখি আর একটি টেবিলের প্রতিনিধিত্ব করছে। সামাজিক সংগঠনের বেলায়ও একই কথা বলা যায়। তাঁরা দলে দলে এসেছেন ও সেইভাবেই বসে পড়েছেন। আমার পাশে বিমানের বাংলাদেশের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক। সেদিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় আমার। নিদান চন্দ্র বড়ুয়া। মাসখানেক হলো আবুধাবি অফিসে যোগদান করেছেন। শিক্ষকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত আমি, কাজেই তাঁর প্রথম প্রশ্নটা আমাকে। বিষয় স্কুল নিয়ে। বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুলের ছাত্রসংখ্যা কত! সঠিকভাবে শিক্ষকরাই বলতে পারবেন। তাই অধ্যাপক আবু তাহের জানালেন ৮২৫। যোগ করলেন শিক্ষকের সংখ্যা ৪৯ জন। টেবিলে আছে খেজুর। গ্লাসে ভরা পানি, লাবান আপ। আম, আপেল, পেয়ারা বা আঙুর রঙের পানীয়। আমার পছন্দ জানতে চাইলেন পাশের বন্ধু। অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান মৃদু সতর্কতা জানালেন। আমি যেন এসব উপাদান আগেই মুখে নেওয়া শুরু না করি! আমার সে জবাব অন্যরা দেন হাসিতে। হজরত মোহাম্মদ (সা.) খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার করতেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত খেজুরের জায়গা। কাজেই নবীর এ নিয়মপালন কেবল কথার কথা হবে না। পাশের সবাই আমার মনের কথাটা বুঝলেন। স্কুলের উপাধ্যক্ষ কাজী আবদুল রহিম সায় দিলেন। আরেক উপাধ্যক্ষ মোখলেসুর রহমান তখন আমার দিকে তাকিয়ে। কথা সত্য, সৃষ্টিকর্তা মানুষের চাওয়া অপূরণ রাখেন না। আজানের ধ্বনি শোনা যায়। হাতগুলো নড়েচড়ে ওঠে। খেজুর মুখে দেন সবাই। সঙ্গে পানি। কী শান্তি কী শান্তি, অনুভূতি সবার। অতিথিরা জায়গা ছেড়ে ওঠেন। পাশে খাবারের গাড়ি। বিরিয়ানিসহ খাবারের নানা উপাদান মজুত রাখা সেখানে। দুই দিকের দুই লাইনে সে ব্যবস্থা। সবাই প্লেট নিচ্ছেন। টুং টাং শব্দ হচ্ছে। তাঁরা টেবিলে এসে খাচ্ছেন। ঝাল খাবারের পাশাপাশি ছিল ডেজার্ট। সেখানেও পছন্দ করার সুযোগ। সব খেতে পারবে না একজন। কেউ কড়া মিষ্টি নেন, কেউবা হালকা। ড. হাবিবউলহকের সঙ্গে অনুষ্ঠানে প্রথমবার কথা হয় এখানেই। শুভেচ্ছা বিনিময় চলছে। তাঁরই সঙ্গে ড. রায়হান জামিল। রসিকতায় পুষ্ট হলাম। একটা কাজ ছিল তাঁর হাতে। টেলিফোনে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, করা হয়ে ওঠেনি। বললাম, অসুবিধা নেই। ইফতার আয়োজন কুশল বিনিময়ের একটি সুযোগ এনে দেয়। দেখা হয় বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে। হাত মেলাই। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল খবর নেন, খেয়েছি কিনা! সম্প্রতি তিনি আহালিয়া গ্রুপ ও আবুধাবি পুলিশের দেওয়া অনন্য অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাই। অনুষ্ঠানে একক বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। রমজান সৃষ্টিকর্তার ইবাদতে আহ্বান জানায়। দেহ ও মনের নিয়ন্ত্রণে শক্তি জোগায় যে নিয়ামক সে এই মাস। সম্মান বা শ্রদ্ধার ভাবটিতে পূর্ণতা আনে এরই পবিত্রতা। উৎসর্গের মনটিও জেগে ওঠে এই সময়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানের বাস বাংলাদেশ। তাঁদের মধ্যে আছে মিলনের একটি ঐক্য। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে আরও বেশি শক্তিশালী করে রোজার এই মাস। সমাজ এ কারণে হয়ে ওঠে সুখের ও সম্প্রীতির। এ মাস ইবাদতের, ভালোবাসারও, বলেন তিনি। রাষ্ট্রদূত ইমরান বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্রটিও সংক্ষেপে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পাঠানো হয়েছে শূন্যে। এ এক বিরল কৃতিত্ব। মহান ঐতিহ্য বাংলাদেশের। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এর অভ্যুদয়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মহানুভবতার স্বাক্ষর রেখেছে দেশ। আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার জন্য তিনি অভ্যাগতদের অভিনন্দন জানান। ইফতার আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন এই দেশের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন যায়েদের ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আলী আল হাসমি। তিনি রাষ্ট্রদূতসহ আয়োজনের অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সবার ইফতার যাতে কবুল হয় সে জন্য দোয়া করেন। বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্ধুত্ব যাতে অটুট থাকে সেই কামনা করেন। প্রধান অতিথি আরবিতে বক্তব্য রাখেন। বাংলা তরজমা করেন দূতাবাসের আইন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল আলম। অনুষ্ঠানে এসেছেন দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ভাইস কনসাল মোহাম্মদ মোহেদুল ইসলাম। ড. মোকসেদ আলী ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। বন্ধুর আলাপ চলছিল। ওখানকার শ্রম বিষয়ক কাউন্সেলর এ এস এম জাকির হোসেন। বললেন, ভালো লাগল। তড়িঘড়ি প্রস্থান করলেন। তাঁরা এলেন, অংশগ্রহণ করলেন ইফতারে, জয় করে গেলেন। তাহলে আর বেশিক্ষণ থাকার প্রয়োজন কী! এসেছেন নিউ মেডিকেল সেন্টার, আল আইনের ডাক্তার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ওখানকার কনসালট্যান্ট সার্জন। এমন উচ্চপর্যায়ে চিকিৎসা পেশায় দ্বিতীয় কেউ নেই এই দেশে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রদূতের ইফতার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। জানালেন, আল আইনের পক্ষ থেকে আবুধাবির বাঙালি সমাজকে একরাশ ভালোবাসা। বিদায়ের ঘণ্টা বাজে। অভ্যর্থনার দলটি বেশ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তাঁরা বিদেশি কূটনীতিকদের হাতে ধরিয়ে দেন বাংলাদেশের একটি সুরম্য থলে। যার মধ্যে আছে দেশে তৈরি পণ্য, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কিত খালিজ টাইমসের বের করা এক্সক্লুসিভ। সেখানে আছেন অভ্যর্থনা কর্মী চন্দ্রিমা বিশ্বাস ইভা। তাঁর সঙ্গে কথা বলি, তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভালোবাসা তুলে দিচ্ছি তাঁদের হাতে। সূত্র: প্রথম আলো আর/১৭:১৪/০৩ জুন



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Jr0b6d
June 04, 2018 at 12:48AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top