জিয়াউদ্দিন আহমদ আমেরিকার সাতজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বেশ কয়েকজন নোবেলজয়ী এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনার নামে যে মর্যাদাপূর্ণ পদকে ভূষিত হয়েছেন, সে একই পদকে ভূষিত হয়েছেন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ, আমাদের সাদেক ভাই। তিনি যখন এই সম্মাননা পান, তখন আমি বাংলাদেশে। প্রথম আলো গুরুত্ব দিয়ে খবরটি পরিবেশন করে এবং খবরের শেষাংশে আমার এক লাইন প্রতিক্রিয়া যোগ করেছিল। এতে আমি বলেছিলাম, ডা. জিয়াউদ্দিনের এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনার প্রাপ্তি আমেরিকায় বাংলাদেশিদের সম্মান বাড়াবে। নিউইয়র্কে ফিরে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছি। দুই সপ্তাহ আগে ফ্লুতে ধরাশায়ী হয়ে বিছানায় শায়িত। এমন সময় ফোন এল রানা ভাবীর (রানা ফেরদৌস চৌধুরী)। কুশলাদির পর তিনি বললেন, আপনার একটা লেখা চাই। নড়েচড়ে বসলাম। ভাবীর প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলাম। এতো আমার সৌভাগ্য। লেখা ঠিকঠাক হবে কিনা জানি না, তবে শ্রদ্ধা জানানোর এ সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না। সাদেক ভাই আমাদের কত উচ্চতায় নিয়ে গেছেন সেটা বুঝি বলেই আমার এই আকুতি। মনে মনে রানা ভাবীকে ধন্যবাদ দিলাম, নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করে এমন একটি বিষয় স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য। সাদেক ভাই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রথমেই যে মুখখানি সামনে আসে, সেটি হচ্ছে তাঁর বাবা শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। সিলেটের মানুষের হৃদয়ে যিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালে জেল রোডের বাসায় আমার অসুস্থ বাবাকে দেখতে এসেছিলেন। সে দিন শ্বেত শুভ্র পোশাকে অনিন্দ্য সুন্দর এক সুপুরুষের ছবি আমার মনে অঙ্কিত হয়, যা আজও অম্লান। তাঁর মানবিক গুণাবলির কথা শুনেছি মানুষের মুখে মুখে। আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও বিখ্যাত শল্যবিদ। একাত্তরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার সময় বর্বর পাকিস্তানি নরপশুরা তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করে। শহরের চৌহাট্টায় তাঁর স্মৃতি স্তম্ভ ও সিলেট মেডিকেল কলেজের একটি ছাত্রাবাস রয়েছে তাঁর নামে। সাদেক ভাইয়ের মা অধ্যক্ষা হোসনে আরা আহমদ সিলেটে নারী শিক্ষার অগ্রদূত এবং জীবন্ত এক কিংবদন্তি। তিনি সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে আমার পেশাগত জীবনে দেখেছি, সিলেটের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়েছে তিনি। সাদেক ভাইকে যত দেখি, তত অবাক হই। ভেবে পাই না, কী করে একজন মানুষের পক্ষে এত কিছু করা সম্ভব। তিনি ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক, কিডনি বিশেষজ্ঞ। নিজের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে মানবিক ও সামাজিক এত কাজ কয়জনের পক্ষে সম্ভব? যেখানেই মানবতার ডাক অথবা সামাজিক দায়িত্বের আহ্বান, ছুটে যান সেখানে। উজাড় করে দেন নিজেকে। ছোটখাটো বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায় না। একদিনের কথা মনে পড়ে। সম্ভবত লং আইল্যান্ডে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। আমি অসুস্থ ছিলাম। জ্বর বা এ জাতীয় কিছু। তখন রাত। সাদেক ভাই কাছে এলেন, আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে কাউকে ফোন করলেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে দেখি ওষুধ এসে হাজির। আমি অবিভূত হলাম। নিউইয়র্কে আমার পেশাগত জীবন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে সাদেক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। তিনি তখন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকার সভাপতি। বিএমএর সম্মেলন সেমিনার আমরা কাভার করতাম। তবে অন্য এক কারণে আমি তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলাম, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের মার্চেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বন্ধু কর্নেল এম এ সালামের সঙ্গে। মেজর হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে ৩ নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতি নিয়ে তাঁর লেখা আমার সম্পাদিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখার ভালো হাত। যা বলছিলাম, অবাক হই সাদেক ভাইয়ের অপরিসীম কর্মক্ষমতায়। ড্রেক্সেল থেকে বইমেলা, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন থেকে বিম্ব সিলেট সম্মেলন, সামাজিক সংগঠন থেকে মূলধারার রাজনীতি, কংগ্রেসে ডোমক্রেটিক পার্টিতে বাংলাদেশের নারী নীনা আহমদের প্রাথমিক বাছাই পর্বের প্রাণ পুরুষ, বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ, সিলেটে কিডনি হাসপাতাল, শ্রীপুরে এনআরবি ভিলেজ, পিতা-মাতার ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশন থেকে দরিদ্রদের সহায়তা, ছাত্রবৃত্তি, মানবতার সেবায় যখন যেখানে ডাক আসে ছুটে যাওয়াসব জায়গায় সাদেক ভাই। অফুরান তাঁর প্রাণশক্তি, অফুরান তাঁর উদ্দীপনা। সমাজে ডা. জিয়াউদ্দিনের অতুলনীয় অবদান ও বিশাল কর্মকাণ্ডের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি দেয় দি এলিস আইল্যান্ড অনার সোসাইটি। তাঁকে সম্মানিত করে মর্যাদাকর এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনারে। এ পদক দেওয়া হয় প্রতি বছর। যাঁরা তাঁদের কর্মে সফল, যাঁরা তাঁদের সেবা, মেধা ও জ্ঞান দিয়ে আমেরিকার সমাজকে আলোকিত করেছেন, তাঁদের এ পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। অত্যন্ত মর্যাদাকর এই পদক মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষে অনুমোদিত এবং প্রতিবছর কংগ্রেসের রেকর্ডে সম্মাননা স্মারক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এই পদকের চেতনা পরমত সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ব ও দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করে। এলিস আইল্যান্ড মেডেল অব অনার চালু হয়েছে ১৯৮৬ সালে। এ পর্যন্ত খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার সাতজন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন, সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস স্যান্ড্রা ডে ও কনর, নোবেলজয়ী এলি উইসেল ও পাকিস্তানের মালালা ইউসুফ জাই, করেটা স্কট কিং, জন সুলে, বিশ্ববিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, লী আইয়াকোকা, রোজা পার্কস। এই পদক দেওয়া হয় বর্ণাঢ্য এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। নিউইয়র্কের এলিন আইল্যান্ড অভিবাসীদের আগমন ও বিবর্তনের ইতিহাসের প্রধান স্মারক। পদক বিতরণের দিন আইল্যান্ড জনসাধারণের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পদকপ্রাপ্ত ও তাদের অতিথিরা দ্বীপে আসেন ব্যক্তিগত ফেরিতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন ৩০০ সেনা। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর পাঁচটি শাখার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দেয়। আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে পদকপ্রাপ্তরা মঞ্চে গিয়ে পদক গ্রহণ করেন। এরপর ঐতিহাসিক গ্রেট হলে অনুষ্ঠিত হয় নৈশভোজ। সাদেক ভাই প্রথম আলোকে তাঁর পদকপ্রাপ্তির প্রতিক্রিয়া বলেছিলেন, আমেরিকায় মূলধারায় সম্মানজনক এই স্বীকৃতি একজন অভিবাসী হিসেবে এ সমাজে আমাদের কর্মের প্রতিদান। যেকোনো সম্মানপ্রাপ্তি নিজের কাজ আর দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ আমেরিকান সমাজে আমাদের যে উচ্চতায় তুলে এনেছেন, তাতে একজন সিলেটী হিসেবে একজন বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত, তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। জিয়া ভাই আপনি বেঁচে থাকুন সব বাঙালি হৃদয়ে, মানবতার সেনাপতি হিসেবে। আপনাকে অভিবাদন। লেখক: নিউইয়র্কে প্রবাসী সাংবাদিক
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2MWy3Gr
July 07, 2018 at 08:21AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন