রংপুর, ২২ আগস্ট- দেবী চৌধুরানী নামে ভারতের কোলকাতার স্টার জলসা চ্যানেলে যে সিরিয়াল (নাটক) দেখানো হচ্ছে সেই সিরিয়ালের গল্প বাংলাদেশের রংপুরের সত্য ঘটনার ওপর নির্ভর করে রচিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। দুই বাংলাতে ব্যাপক জনপ্রিয় এই সিরিয়ালের মূল চরিত্র দেবী চৌধুরানীর রংপুরের পীরগাছা উপজেলা কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকসুদ খাঁ গ্রাম থেকে ঘুরে এসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন- রওশন আলম পাপুল। দেবী চৌধুরানী মানে এক জীবন সংগ্রামীর কাহিনী। বাল্যকালেই যিনি হয়েছেন পিতৃহারা, লাঞ্ছনা আর অপমানের শিকার। সহায়-সম্বলহীন মায়ের সঙ্গেই বেড়ে ওঠেন দেবী চৌধুরানী। সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে দুঃখ-কষ্ট জয় করে একসময় ইংরেজ ও জমিদারদের শাসন-শোষণের শিকার নিরীহ মানুষদের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন দেবী চৌধুরানী। সেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ১৮৮৪ সালে লেখনির মাধ্যমে ফুটে তুলেছেন লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালেই। লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ শাসনামলে রংপুর জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লেখক এবং একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে তিনি দেবী চৌধুরানীর জীবনভিত্তিক এই উপন্যাস রচনা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবিতকালে দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটির ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দেবী চৌধুরানী সিরিয়ালটি গত ১৬ জুলাই থেকে স্টার জলসায় বাংলাদেশ সময় প্রতিদিন রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত দেখানো শুরু হয়। দেবী চৌধুরানী সিরিয়াল ও উপন্যাস থেকে জানা যায়, দেবী চৌধুরানীর এই ঘটনা ১৭০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকের। প্রথমে দেবী চৌধুরানীর নাম ছিল প্রফুল্ল। বাড়ি ছিল রংপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রাম দুর্গাপুরে। এই গ্রাম থেকে ছয় ক্রোশ (প্রায় ১৪ কিলোমিটার) দূরে ভুতনাথ গ্রামের জমিদার হরবল্লভের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় প্রফুল্লের। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে শ্বশুর হরবল্লভ পুত্রবধূ হিসেবে প্রফুল্লকে মেনে না নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এ সময় প্রফুল্ল বলেন, এবার কোথায় যাব আমি। এর উত্তরে হরবল্লভ বলেন, যেখানে খুশি যাও। চুরি করো, ভিক্ষে করো, পারলে ডাকাতি করো। পরে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন ডাকাতদের রানী, নতুন নাম হয় দেবী চৌধুরানী। ধনীদের কাছে থেকে ডাকাতি করা অর্থ এনে গরিব-দুঃখী মানুষদের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন দেবী চৌধুরানী। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকসুদ খাঁ গ্রামে ছিল এই দেবী চৌধুরানীর ভবন। দেবী চৌধুরানী এই গ্রামেই থাকতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন জনসাধারণের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং জনসমর্থনের কারণে ইংরেজরা দেবী চৌধুরানীকে মেয়ে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করলেও শত চেষ্টা করে আটক করতে পারেনি। তবে ইতিহাস অনুসন্ধানী অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখিত প্রফুল্ল নয় বরং দেবী চৌধুরানী ছিলেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার জয়দূর্গাদেবী (ব্রাহ্মণাদেবী) নামের শিবুকুণ্ঠিরাম (বামনপাড়া বা ভুতছড়া) গ্রামের ব্রজ কিশোর রায় চৌধুরী ও কাশিশ্বরী দেবীর মেয়ে। পীরগাছার জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং সন্যাস বিদ্রোহের সময় তিনি জমিদার ছিলেন। তবে ইংরেজ সরকারের তৎকালীন দলিল দস্তাবেজে দেবী চৌধুরানী জমিদার ছিলেন কিনা বা এতে তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। দেবী চৌধুরানী উপন্যাস সম্পর্কে লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন, দেবী চৌধুরানী গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরানীর মিল বড়ই অল্প। তা শ্রীযদুনাথ উপন্যাসটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রফুল্লই যে দেবী চৌধুরানী ছিলেন সেটাই আজও সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু দেবী চৌধুরানীর ঐতিহাসিক এ ঘটনার স্থাপনা সংরক্ষণ করা হয়নি আজও। ফলে তার স্মৃতিচিহ্নগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দেখার মতো কোনো স্থাপনা টিকে নেই। এখন এখানে শুধু মকসুদ খাঁ গ্রামে দেখতেই পাওয়া যাবে স্থাপনার জায়গায় ইটের টুকরা। সরেজমিনে দেখা যায়, বগুড়ার শান্তাহার-গাইবান্ধার বোনারপাড়া-রংপুরের কাউনিয়া রেলরুটের রংপুরের চৌধুরানী স্টেশন থেকে বের হয়ে পাকা রাস্তা ধরে রংপুরের দিকে যেতে হাতের ডান দিক দিয়ে হেঁটে চৌধুরানী বাজারে যেতে সময় লাগবে ৫ মিনিট। বাজারে কৈকুড়ী ইউনিয়ন পরিষদ পার হয়ে যাওয়ার পর হাতের বাম পাশে একটি পাকা রাস্তা পাওয়া যাবে। এই রাস্তাটি গেছে জালালগঞ্জ বাজারের দিকে। এখান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাযোগে জালালগঞ্জ রোডের রামচন্দ্রপাড়ার নুরনবীর দোকানের পেছন দিয়ে গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ দিয়ে যেতে হবে পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়ার আব্দুল মোত্তালেব, চাঁন মিয়া ও আবু দাইয়ানের বাড়ি সংলগ্ন দেবী চৌধুরানীর পুরনো স্থাপনার জায়গায়। চৌধুরানী বাজার থেকে জালালগঞ্জ বাজারের দিকে যাওয়ার সময় রাস্তার দুই পাশে দেখা মিলবে সারি সারি নারিকেল গাছ। যা দেখতে দৃষ্টি কাড়বে সবার। এই স্থাপনার জায়গাটি থেকে পশ্চিম দিকে ঘাঘট নদীর তীরে পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তারপাড়া গ্রামে ছিল আরেকটি স্থাপনা। এই স্থাপনার জায়গাটি এখন ঘন গাছ-পালায় পরিপূর্ণ। স্থাপনার জায়গা ঘিরে এখনো রয়েছে দেবী চৌধুরানীর আমলে তৈরি করা একটি খাল। এ ছাড়া চৌধুরানী বাজারের উত্তর পাশে মসজিদ সংলগ্ন দেবী চৌধুরানীর একটি বিশাল পুকুরের দেখা মিলবে। গাইবান্ধা শহর থেকে পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়া ও পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তার পাড়া গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। এ ছাড়া সড়কপথে যাওয়া যাবে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের চৌধুরানী বাজারে। যেতে হবে গাইবান্ধা শহরের জিরো পয়েন্টের পুরাতন জেলখানা মোড় থেকে ম্যাজিক গাড়িতে। নামতে হবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাইপাস রোডে। এখান থেকে রংপুরমুখী বাসগুলো চৌধুরানী বাজারের ওপর দিয়ে যায় রংপুর শহরে। পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়া গ্রামে যেখানে দেবী চৌধুরানীর একটি স্থাপনা ছিল। সে জায়গাটির মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি এখনো পতিত রয়েছে। সেখানে বাঁশঝাড়, সুপারি, পেয়ারা ও কচুগাছ রয়েছে। জন্মেছে ছোট-বড় আগাছা। ডেবে যাওয়া ওই স্থানের ওপরে ও আশেপাশে ইটের টুকরা দেখতে পাওয়া যায়। পতিত জমির মালিকানায় রয়েছে চারজন। আশেপাশে গড়ে উঠেছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক বসতবাড়ি। এসব বাড়ির আঙ্গিনায় দেখা মিলবে সেই সময়ের ইটের টুকরা। দেবী চৌধুরানীর আরেকটি স্থাপনা রয়েছে পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তার পাড়া গ্রামের ঘাঘট নদীর তীরে। এই স্থাপনার জায়গায় গড়ে উঠেছে নার্সারি, আম বাগান, আখ ও সবজির খেত। জায়গাটির চারপাশে রয়েছে একটি খাল। নদীভাঙলে দেবী চৌধুরানীর স্থাপনার ইট দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়া গ্রাম থেকে পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তার পাড়া জামে মসজিদের পাশে দিয়ে পশ্চিম দিকে স্থাপনাটিতে হেঁটে যেতে সময় লাগবে প্রায় ১০ মিনিট। স্থানীয়রা জানায়, দেবী চৌধুরানীর স্থাপনা দুটি মাটির নিচে ডেবে গেছে অনেক আগেই। বর্তমানে দেবী চৌধুরানীর স্থাপনার সম্পত্তি বংশ পরম্পরায় ভোগদখলে আছে। দুটি স্থাপনা অনেক উঁচু ছিল। সময়ের বিবর্তনে এখন স্থাপনার জায়গাগুলো নিচু হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে ভারতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসেন দেবী চৌধুরানীর স্থাপনা দেখতে। পূর্ব মকসুদ খাঁ হাজীপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মোত্তালেব (৭০) বলেন, দেবী চৌধুরানীর স্থাপনা দেখতে অনেকেই আসেন এই এলাকায়। কিন্তু এখন আর স্থাপনা নাই। এরপরও ভারতের কলকাতা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে আসেন। আমার পূর্ব-পুরুষদের কাছে শুনেছি, আমাদের বাড়ির পাশে দেবী চৌধুরানীর একটি স্থাপনা ছিল। আরেকটি স্থাপনা ছিল পশ্চিম মকসুদ খাঁ ডাক্তার পাড়া এলাকায় ঘাঘট নদীর তীরে। দুটি স্থাপনাই এখন মানুষের দখলে। সূত্র: জাগোনিউজ২৪ আর/০৭:১৪/২৩ আগস্ট
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2BD5ooP
August 23, 2018 at 03:10PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন