কলকাতা, ১৬ নভেম্বর- ক্যালকাটা মুসলিম অরফ্যানেজ ভারতের বড় অনাথ আশ্রমগুলির মধ্যে অন্যতম৷ অনাথ শিশুদের প্রতিপালনের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র পড়ুয়াদের জন্য এর অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ৷ ১২৫ বছর পার করেছে প্রতিষ্ঠানটি৷ শিশুপাচার বা নিগ্রহ রুখতে সরকারি তরফে নানারকম কর্মসূচি নেওয়া হয় বছরভর৷ চাইল্ড হেল্পলাইনের প্রচারও চলে ব্যাপক৷ তবুও এ শহরের বুকেই পথেঘাটে চোখে পড়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির বালক-বালিকা, যাদের মাথার উপর ছাদ নেই, ধরার মতো অভিভাবকের হাত নেই৷ আবার এই শহরেই এমন শিশু বা বালক-বালিকার জন্যই ক্যালকাটা মুসলিম অরফ্যানেজ (সিএমও) ব্যবস্থা করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিংবা উচ্চশিক্ষার৷ ১৮৯২ সালে আবদুল হাসান খান এবং তাঁর সহযোগীরা সিএমও স্থাপন করেন৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি ঘটে৷ বতর্মানে এর আবাসিক বালক-বালিকার সংখ্যা ১০০০৷ সিএমও-র এক সদস্য বলছিলেন, এই প্রতিষ্ঠান সত্যি বিশিষ্টতার দাবি রাখে৷ আর পাঁচটা অনাথ আশ্রম বলতে যা বোঝায়, ব্যাপারটা তা নয় মোটেই৷ মুসলিম সমাজে এই অনাথ আশ্রমের পরিচালন কমিটির সদস্য হওয়া খুবই গর্বের ব্যাপার৷ অনেক ভেবেচিন্তেই এখানে সদস্য নির্বাচন করা হয়৷ সমস্ত খরচ চালানোর জন্য এখানে বছরে ৭৮ লক্ষ টাকার বাজেট থাকে৷ তাতে বিভিন্ন দানের পাশে থাকে রাজ্য সমাজকল্যাণ দপ্তরের অনুদানও৷ সিএমও-র ভবন ভাড়া দিয়ে আয় হয়৷ বালিকা বিভাগের নব নির্বাচিত চেয়ারপার্সন সানা আহমেদ জানালেন, বিভিন্ন অনুদানের পাশাপাশি মুসলিমদের পবিত্র দানের (জাকাত) উপর নির্ভর করে এই অনাথ আশ্রমের সম্পত্তি ১০০ কোটি টাকারও বেশি হয়ে উঠেছে৷ এর মধ্যে রয়েছে ৪টি স্কুলও৷ এই স্কুলগুলির পঠনপাঠন নিঃসন্দেহে শহরের যে কোনো খ্যাতনামা স্কুলের সঙ্গে তুলনীয়৷ উর্দু, হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি এমন চারটি ভাষায় চলে স্কুলগুলির পঠনপাঠন৷ রিপন স্ট্রিটের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এ কে ফজলুল হক হাই গার্লস স্কুলের ছবিটা তুলে ধরলেই বোঝা যাবে, পঠনপাঠনের চেহারাটা কেমন৷ সিএমও-র অধীনে স্থাপিত এই স্কুলটি পুরো ইংরেজি মাধ্যমের৷ রয়েছে একটি বৃহৎ পাঠাগারও৷ শহরের অনাথ এবং পিছিয়ে পড়া দুঃস্থ বালিকারা এই স্কুলে পড়াশুনো করে৷ এই বালিকাদের পরিবারের অনেকেই পড়াশুনো জানেন না৷ মুসলিম পড়ুয়াদের ইসলাম ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার ব্যবস্থাও এখানে আছে৷ তবে সেটা জোরপূর্বক নয়৷ কারও ইচ্ছে থাকলে তবেই সে পড়বে৷ সিএমও-র সহ-সম্পাদক সামশুল হাসান খান ডয়চে ভেলেকে বললেন, অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে যে, মুসলিম সম্প্রদায়ে শুধু মাদ্রাসা আর উর্দু মিডিয়াম স্কুলেরই চাহিদা আছে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যাঁদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর সামর্থ্য আছে, তাঁরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতেও উৎসাহী৷ তাঁরা বুঝেছেন, বৃহত্তর পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াতে ইংরেজিই ভরসা৷ সিএমও-এর এই স্কুলগুলিতে সব ধর্মের পড়ুয়ারাই ভর্তি হয়৷ তবে বেশিরভাগই দুঃস্থ, পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে আসে৷ অনাথ পড়ুয়াদের বিনা বেতনেই শিক্ষাদান করা হয়৷ এ কে ফজলুল হক গার্লস হাই স্কুলের মতোই আবুল হাসান স্কুলের পঠনপাঠনও প্রশংসা করার মতো৷ সপ্তম শ্রেণির পারভিনা আখতার স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে৷ তার মতো আরো অনেকে স্পষ্ট ইংরেজিতে গড়গড় করে স্বপ্ন ছোঁয়ার কথা বলে যায়৷ ২০০৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম যোগ দিয়েছিলেন এই ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠার সময়৷ উলুবেড়িয়ার বর্তমান সাংসদ সাজদা আহমেদ প্রথমবার এই প্রতিষ্ঠানের মহিলা প্রেসিডেন্ট রূপে দায়িত্ব নিয়েছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, যাদের উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা আছে, তারা যাতে সেটা চালিয়ে যেতে পারে, সেটার ব্যবস্থা করা হবে৷ অতীতে রাজনীতি দখল নিয়েছিল সিএমও-র৷ প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম ২০০০ সাল থেকে এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট ছিলেন৷ তারপরে রাজনীতির পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে প্রয়াত তৃণমূল নেতা ও উলুবেড়িয়ার প্রাক্তন সাসংদ সুলতান আহমেদ ছিলেন প্রেসিডেন্ট৷ তাঁর মৃত্যুর পর এতদিন এই পদ খালিই ছিল৷ এবার সেই পদে নির্বাচিত হলেন তাঁর স্ত্রী সাজদা আহমেদ৷ সাজদা অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহু আগে থেকেই যুক্ত৷ তাঁর কাছে বালক-বালিকার মধ্যে কোনও ভেদ নেই৷ সবাই সমান৷ কাজেই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের সমান গুরুত্বই দরকার বলে তিনি মনে করেন৷ তাই প্রেসিডেন্ট হয়ে বালিকাদের জন্য আলাদা কিছু করার কোনো পরিকল্পনা তাঁর আপাতত নেই বলে ডয়চে ভেলেকে জানালেন৷ সাজদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, পঠনপাঠনের উন্নতি গত কয়েক বছরে অনেকটাই হয়েছে৷ তবে এখনো কিছু কাজ করতে হবে৷ কম্পিউটারের মতো আধুনিক বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে৷ আবাসিকদের পড়ার পাশাপাশি খেলার মাঠও দরকার৷ তবে তেমন কোনো জায়গা নেই এখানে৷ আবাসিকদের থাকার জায়গার পাশাপাশি মুক্ত পরিসরের ব্যবস্থা করতে হবে৷ শিশু বয়স থেকে ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব নেয় সিএমও৷ যতদিন না এরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, ততদিন সিএমও অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে৷ বালকদের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ১৮ বছর অবধি তাদের ভার নেওয়া হয়৷ তারা যদি উচ্চশিক্ষার শিক্ষিত হতে চায়, তবে সংস্থাই তার ব্যবস্থা করে৷ ১৯৯৮ সালে শিশুকল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য এই সংস্থা রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে পুরস্কারও লাভ করেছে৷ সানা আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বললেন, উপযুক্ত বয়স হলে সিএমও মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়েরও ব্যবস্থা করে৷ লেখাপড়ার ওপর জোর তো দেওয়া হয়ই৷ সন্ধে বেলা বিভিন্ন বিষয়ের প্রাইভেট টিউশনেরও ব্যবস্থা করা আছে এখানে৷ পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের জন্য আলাদা ক্লাসেরও ব্যবস্থা থাকে৷ এমএ/ ০৩:৪৪/ ১৬ নভেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2BblJil
November 16, 2018 at 09:58PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top