দিসপুর, ০৯ ডিসেম্বর- আসামে চা বাগানের দুশো বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী বাগানের ম্যানেজারের পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ব্রিটিশরা আসামে চা বাগান শুরু করেছিল প্রায় দুশো বছর আগে। কিন্তু চা বাগানগুলোতে উচ্চপদে এতদিন কাজ করেছেন শুধু পুরুষরাই। নারী শ্রমিকরা এখনও পাতা সংগ্রহের মতো কঠিন পরিশ্রমের বেশীরভাগ কাজগুলোই করেন। এতদিনের এই ব্যবস্থা বদলিয়ে এবার এক নারী দায়িত্ব নিয়েছেন চা বাগানের প্রধানের। ম্যানেজারের পদে বসেছেন ৪৩ বছরের মঞ্জু বড়ুয়া। ৬৩৩ হেক্টরেরও বেশি জায়গা জুড়ে থাকা বাগানটির আনাচে কানাচে মোটরবাইক বা সাইকেল অথবা জিপে চেপে ঘুরে বেড়ানোর কাজ তার। আসাম বা উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলোতে ম্যানেজারদের সম্বোধন করা হয় বড় সাহেব বলে। একসময়ে ব্রিটিশরাই ওই পদে আসীন হতেন, তাই এই সম্বোধন। এখন মিসেস বড়ুয়া ম্যানেজারের পদে আসীন হওয়ার পরে আসামের তিনসুকিয়া জেলার হিলিকা চা বাগানের শ্রমিক কর্মচারীরা অভ্যস্ত হচ্ছেন তাকে বড় ম্যাডাম বলতে। মঞ্জু বড়ুয়া বলছিলেন, চা বাগানের দায় দায়িত্ব সামলানো একজন নারীর জন্য কঠিন হলেও অসম্ভব কোন কাজ নয়। মিসেস বড়ুয়া বলছিলেন, এটা ঠিকই যে এতদিন চা বাগানে পুরুষরাই ম্যানেজার হয়ে এসেছেন। পুরুষ হলে হয়ত কিছুটা সুবিধা থাকে। কাজটা কঠিন। তবে নারীরা পারবেন না মোটেই এমন নয়। কিন্তু শারীরিক আর মানসিকভাবে ফিট থাকতে হবে। আর চা বাগানের কাজের প্রতি থাকতে হবে ভালবাসাও। এগুলো থাকলে নারীদের কাছেও অসম্ভব নয় চা বাগানের ম্যানেজারের কাজ করা। আমার বাগানের এলাকা ৬৩৩ হেক্টর। গোটা বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরতে হয় - কখনও সাইকেলে, কখনও জিপে, কখনও মোটরসাইকেলে। আমি সবগুলোই চালাতে পারি। একাই যাই বাগানের নানা দিকে। এত পরিশ্রম করতে হয় সারাদিন যে আলাদা ভাবে ফিট থাকার জন্য ব্যায়াম করতে হয় না। তবে মানসিকভাবে ফিট থাকতে ধ্যান করি নিয়মিত, - জানাচ্ছিলেন মিসেস বড়ুয়া। শ্রমিক কর্মচারীরা এত বছর ধরে বাগানের প্রধান হিসাবে একজন পুরুষকেই দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই নারী হিসাবে বড় কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে এখনও পড়তে হয়নি। মঞ্জু বড়ুয়া বলছিলেন তিনি কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেছিলেন শ্রমিক কল্যাণ অফিসার হওয়ার জন্য। কাজে যোগ দেওয়ার পরে এই বাগানেই গত ১৮ বছর ধরে কাজ করছেন। একেবারে তৃণমূল স্তরে শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে মিশেছেন। দীর্ঘদিন ধরে বাগানে কাজ করছি একেবারে নিচু স্তর থেকে। তাই বাগানের নারী ও পুরুষ সব শ্রমিক কর্মচারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল। এতদিন ধরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চেষ্টা করেছি সব শ্রমিক কর্মচারীর প্রয়োজন মেটাতে। তাই যখন গোটা বাগান সামলানোর দায়িত্ব পেলাম, আমার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে নি কেউ। নিজেদের কাছের লোক বলেই মেনে নিয়েছে সবাই, বলছিলেন মঞ্জু বড়ুয়া। আসামের শিবসাগর জেলার একটি ছোট এলাকা নাজিরার মেয়ে মঞ্জু। চা বাগানে কাজ করবেন, এরকম স্বপ্ন কম বয়সে দেখেন নি। চেয়েছিলেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেবেন। কিন্তু বাবার অবসরের পরে প্রয়োজন ছিল চাকরির। তখনই কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে চা বাগানের শ্রমিক কল্যাণ অফিসারের কাজে যোগ দেন। বাগানের বাংলোতেই থাকেন মিসেস বড়ুয়া - স্বামী আর ১১ বছরের কন্যাকে নিয়ে। ভোর থেকে বাগানের কাজ শুরু হয়ে যায়, একই সঙ্গে তার ছুটোছুটিও। মিসেস বড়ুয়া বলছিলেন, আগে থেকে প্ল্যান না করে রাখলে খুব অসুবিধা হয় দুটো দিক সামলাতে। বাগানের নিয়ম অনুযায়ী খুব ভোরে - ছটা সাড়ে ছটার মধ্যে কাজ শুরু হয়। আমিও তখনই বেরিয়ে যাই। তবে সাড়ে সাতটায় ব্রেকফাস্টের একটা ছুটি হয়। সেই সময়ে বাংলোয় ফিরে এসে মেয়েকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিয়ে আবার কাজে ফিরি। আবার দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে আসি মেয়েকে দেখাশোনা করতে। এইভাবেই দুটো সামলাচ্ছি। তাদের বাগানটির মালিক কলকাতার এপিজে সুরেন্দ্র গ্রুপ - যাদের অনেক চা বাগান আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সংস্থার চেয়ারম্যান করণ পল বলছেন, মঞ্জু বড়ুয়া যোগ্যতা দেখিয়েই এই পদে উঠে এসেছেন। সবটা তারই কৃতিত্ব। কিন্তু চা বাগানের মতো একটা শিল্প, যেখানে পুরুষরাই মূলত মাথায় বসে এসেছেন এতকাল, সেখানে যদি মঞ্জু বড়ুয়ার সাফল্য দেখে, অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য নারীরাও এগিয়ে আসেন চা বাগানের গুরুদায়িত্ব সামলানোর মতো কাজে, সেটাই হবে আসল সাফল্য। মঞ্জু বড়ুয়া বলছিলেন, চেয়ারম্যান যেদিন তাকে ডেকে ম্যানেজারের পদে প্রোমোশনের কথা জানিয়েছিলেন, সেদিন আনন্দে এতটাই আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন যে পদোন্নতির জন্য চেয়ারম্যানকে থ্যাঙ্ক ইউ বলার বদলে কনগ্র্যাচুলেট করে ফেলেছিলেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা আর/০৮:১৪/০৯ ডিসেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Eo6PIc
December 09, 2018 at 02:22PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top