লুনায় একাট্রা বিএনপি : মহাজোটের প্রার্থী হয়েও এহিয়া’কে লড়তে হবে একা!

Yahya-Lunaমো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ (সিলেট) থেকে :: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ‘লাঙ্গল’ প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া অংশ নিলেও এবার নির্বাচনের মাঠে তাকে একাই লড়াই করতে হবে! এমনটাই মনে করছেন অনেকেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া। এবারের নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামীলীগ থেকে ‘নৌকা’র কোন প্রার্থী মনোনয়ন না পাওয়ায় এহিয়ার চৌধুরীর প্রতি ক্ষুব্ধ রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাই ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা এবার মহাজোটের প্রার্থী এহিয়া চৌধুরীর পক্ষে কাজ করতে নারাজ। এদিকে, এবারের নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ থাকায় এবং আওয়ামীলীগ ঘরানার দুই প্রার্থী অংশগ্রহন করায় এমন পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জিং অবস্থানে রয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। তার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না সাবেক সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী’সহ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিনী তাহসিনা রুশদির লুনাকে নিয়ে একাট্রা রয়েছে বিএনপি। এমতাবস্থায় বিএনপি প্রার্থী তাহসিনা রুশদি লুনা বিপুল ভোটে নিশ্চিত বিজয়ী হবেন এমনটাই মনে করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

১৯৯১ সালে এ আসনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজুর রহমান, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির এম ইলিয়াস আলী। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে সিলেট-২ আসনে প্রতিদ্বদ্বিতা করেন মুহিবুর রহমান। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন মুহিবুর রহমান। এরপর ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রাপ্তি নিয়ে সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মুহিবুর রহমানের মধ্যে সৃষ্টি হয় দন্ধ। এক পর্যায়ে মুহিবুর রহমান আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ ও মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ইলিয়াস আলীকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন শফিকুর রহমান চৌধুরী। তখন দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে মুহিবুর রহমান সংসদ নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। এরপর ১০ম সংসদ নির্বাচেন ফের শফিক চৌধুরী ও মহিবুর রহমান মনোনয়ন যুদ্ধে অবতির্ণ হলে বঞ্চিত হন দু’জনই। আসনটি চলে যায় জাতীয় পার্টির কব্জায়। মহাজোটের প্রার্থী হয়ে এমপি হন ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুহিবুর রহমান বিদ্রুহী প্রার্থী হলেও তিনি পরাজিত হন। নির্বাচনে এহিয়া চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেন শফিক চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কিন্ত সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যায় রাজনীতির চিত্র। এহিয়া চৌধুরীর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় শফিক চৌধুরীর। আর আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে কাজ শুরু করেন মুহিবুর রহমান। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এহিয়া চৌধুরীকে ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ। তাই একদিকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা শুরু করেন শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। অন্যদিকে আবারো মহাজোটের মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালান এহিয়া চৌধুরী। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে মহাজোটের মনোনয়ন প্রত্যাশী তিন চৌধুরীকে ঘিরেই চলে নানা হিসাব-নিকাশ। মনোনয়ন পেতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্ত আবারো এই আসনটি জাতীয় পার্টিকে অঘোষিতভাবে ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেয়নি। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন শফিক চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারী নেতাকর্মীরা। তারা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করলেও কোন লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত এহিয়া চৌধুরী মহাজোটের প্রার্থী হচ্ছেন তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে দলের প্রতি এবং নেত্রীর প্রতি অনুগত থেকেছেন শফিক চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তবে তাদের দু’জের মধ্যে কেউই নৌকা’র মনোনয়ন না পাওয়ায় আবারো নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিশ্বনাথের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা মুহিবুর রহমান ও আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদার। ইতিমধ্যে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলে তারা নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। এই আসনে নৌকা’র কোন প্রার্থী না থাকায় বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ। তারা বর্তমান সাংসদ এহিয়া চৌধুরীকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তাই অনেকেই ফেসবুকে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে এহিয়া চৌধুরীকে নিয়ে বিভিন্ন কটুক্তিমূলক মন্তব্য করছেন। ক্ষুব্ধ অনেকেই মহাজোট প্রার্থী এহিয়া চৌধুরীর বিকল্প হিসেবে মুহিবুর রহমান ও অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদারকে দেখছেন। আবার ক্ষুব্ধ কেউ কেউ মহাজোটের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে প্রয়োজনে ধানের শীষের প্রার্থীকে ভোট দিবেন বলেও মন্তব্য করেছেন।

এদিকে, এহিয়া চৌধুরীর ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী’সহ উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা। গত ২৮ নভেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা শেষে উপস্থিত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এমপি এহিয়া তার পাশে দাড়ানোর জন্য শফিকুর রহমান চৌধুরীকে ডাক দেন। এসময় এহিয়া চৌধুরী তাকে ডেকে আনতে এগিয়ে গেলেও ডাকে সাড়া না দিয়ে চলে যান শফিক চৌধুরী। এমনকি শফিকুর রহমান চৌধুরী’সহ উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র অনেক নেতার বাড়িতে গিয়েও সাড়া পাচ্ছেন না এহিয়া চৌধুরী।

এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে- আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলয়ের মুহিবুর রহমান আর শফিকুর রহমান চৌধুরী বলয়ের ড. এনামুল হক সরদার প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। এই দুই প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে না হলেও অভ্যন্তরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন দুই বলয়ের অনেকেই। কিন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা নেত্রীর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত মনে করলেও বিদ্রুহী এই দুই প্রার্থী থাকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। তবে মহাজোটের প্রার্থী এহিয়া চৌধুরীকে ২য় বারের মতো এমপি নির্বাচিত করতে তার পক্ষে এবার শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কি ভূমিকা রাখবেন এবং তাদের অনুসারী বিশ্বনাথ-ওসমানীনগরের আওয়ামী লীগ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী মাঠে মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে কতটুকু আন্তরিকভাবে কাজ করবেন তা দেখার বিষয়। দলীয় নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন জানিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র একাধিক নেতা বলেন- যারা আওয়ামীলীগের খাঁটি কর্মী তারা নেত্রীর সিদ্ধান্তের বাহিরে কাজ করার সুযোগ নেই। দলের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা তারা এখনো পাননি। দলীয় সিদ্ধান্ত ও সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা পেলে সেই অনুযায়ী তারা কাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানান।

এদিকে, অনেক জল্পনা কল্পনার, আলোচনা-সমালোচনা ও ধ্রুমজালের মধ্যদিয়ে নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিনী তাহসিনা রুশদী লুনা ও পুত্র আবরার ইলিয়াস অর্ণব এর মনোনয়নপত্র বৈধ হওয়ায় উৎফুল্ল বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। যদিও কৌশলগত কারণে তাহসিনা রুশদী লুনা ও পুত্র আবরার ইলিয়াস অর্ণব মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। দলীয় জানা গেছে, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন ইলিয়াসপুত্র অর্ণব, আর ধানের শীষ প্রতীকে ভোটের মাঠে লড়বেন তাহসিনা রুশদী লুনা। বিভিন্ন মামলা-হামলায় নেতাকর্মীরা জর্জরিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনীতির মাঠে নেতাকর্মীদের সবর উপস্থিতি না থাকলেও ইলিয়াসপত্নী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে নিয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ। বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলার ভোটাররা নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর প্রতি বেশ আবেগতাড়িত। তাই এই আসনে তাহসিনা রুশদীর লুনা প্রার্থী হওয়ায় ভোট বিপ্লব ঘটবে বলে আশাবাদী বিএনপির নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে, সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন যদি মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামীলীগ-জাতীয় পার্টি মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন তাহলে এই আসনে শক্ত লড়াই হবে ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া ও তাহসিনা রুশদি লুনার মধ্যে।



from সিলেট – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ https://ift.tt/2St4HCa

December 07, 2018 at 03:49PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top