ঢাকা, ২২ জানুয়ারি- কিশোর মনে একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যা ভীষণ আঘাত দিয়েছিল। নির্মম সেই দৃশ্য সরাসরি দেখে নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারেননি তিনি। ২৫ মার্চেই জিঞ্জিরাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বলা হচ্ছে, বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। অসীম সাহসী এই যোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বন্দী করা হয়েছে একাধিকবার। তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা। তারপরেও তিনি সাহসিকতার সঙ্গে বেঁচে ফিরেছেন এবং লড়ে গেছেন। কারাগারে পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হওয়া এবং নির্যাতনের স্মৃতিচারণ করে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেছিলেন, একাত্তরে আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি এবং যুদ্ধ বন্দিও হয়েছি একাধিকবার। মনে পড়ে, অক্টোবর মাসে প্রথম আমি বন্দী হই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে যে লোকাল রাজাকার ছিল তাদের হাতে ধরা পড়ি। আমরা চারজন ছিলাম। আমাদেরকে আর্মি ক্যাম্পে নেয়া হলো। সেখানে সচরাচর যে কাজটি করা হতো তা হলো মেরে ফেলা। আমাদেরকেও গরম পানি দিয়ে গোসল করানো হলো, সুরা পড়ানো হলো, চোখে কালো কাপড় পেঁচানো হলো। এক পর্যায়ে তারা আমাদেরকে বললো, লাইন আপ করে দাঁড়াতে। মেশিন গান তাক করলো মেরে ফেলার জন্য। আমরা সেখান থেকে দৈবক্রমে বেঁচে গেছি। হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার এলো আমাদের থেকে আরও কথা বের করতে। তাই আমাদের না মেরে ওরা বিবস্ত্র অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলো। সেখানে মেজর আলি নেওয়াজের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি স্বীকার করি যে আমি মুক্তিযোদ্ধা। তারা সেখান থেকে নিয়ে গেল জেলে। গিয়ে দেখি সেখানে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা বন্দী। সবার সঙ্গে পরিচয় হয়। দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম। সেখানে লিডার হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম নজরুল ভাইকে। ২৭ রমজানে আমরা সবাই ইফতার করতে বসেছি। আজান দেয়ার এক দুই মিনিট আগে জেলের ভারী লোহার দরজা খুলে গেল। রাজাকার ও আর্মিরা ঢুকল। আমাদের লাইন আপ করতে বললো তারা। আঙুল দিয়ে ইশারা করে কিছু বন্দীকে ডেকে নিয়ে গেলো। তখন আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম যে আসলে কাদেরকে মারবে। সাহস করে ব্রিগেডিয়ারের কাছে জিজ্ঞেস করলাম যে আমাদের নিয়ে কী করছেন? তিনি বললেন, আজকের এই দিন অনেক পবিত্র দিন। এইদিনে কেউ মরে গেলে সে আল্লাহ পাকের কাছে চলে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে ডিভিশন করলেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, সাত দিন আগে যাদেরকে ধরা হয়েছিল তাদের আজ মেরে ফেলা হবে, তোমাদের পালা আগামীকাল। ভয় না পেলেও বিচলিত হয়েছিলাম শুনে। চোখের সামনেই তাদের মেরে ফেলেছে। পরদিন আমরা রাজাকারদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে ইন্টারোগেশন সেল থেকে পালিয়ে আসি। পালিয়ে যাওয়ার পর মায়ের কাছে ফিরে আসি। বন্দী অবস্থায় খেতে পারিনি। মাকে বলি, আমি অনেক ক্ষুধার্ত। রান্না করো, অনেক কিছু খাব। মা সারা রাত রান্না করেছেন। ভোর পাঁচটায় মা ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। ঠিক তখন, বাসার চারদিক আবার পাকিস্তানের আর্মি ঘিরে ফেললো। আবার ধরে নিয়ে গেল আমাকে। প্রথমে ক্যান্টনমেন্ট, তারপর রমনা থানায়। এরপর অনেক অনেক টর্চার, অনেক অনেক মৃত্যু আবারও। সেখানে বন্দী হওয়া ৮১ জন এর মধ্যে বেঁচে যাওয়া সতের জনের মধ্যে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেঁচে যাওয়া তিন জনের মধ্যে আমি একজন। আমি মনে করি আমি যে সমস্ত গান বা সুর রচনা করেছি সেগুলো আমার গান না। সেগুলো তিরিশ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার গান, যাদের রক্তের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীন এই সুন্দর দেশটাকে অর্জন করেছি। ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মঙ্গলবার ভোর সোয়া ৪টার দিকে নিজ বাসায় হার্ট অ্যাটাকের পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। এর আগে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বুলবুলের হার্টে আটটি ব্লক ধরা পড়ে। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এমএ/ ০৮:০০/ ২২ জানুয়ারি
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2sHKY6Y
January 23, 2019 at 02:29AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন