কলকাতা, ০৫ ফেব্রুয়ারি- গত তিন দিন ধরে ভারতের কলকাতা শহরে যে হাইভোল্টেজ ড্রামা চলছে, এদিন (মঙ্গলবার) সুপ্রিম কোর্টের রায় তাতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি আনলেও এই সংঘাত যে সহজে মিটছে না তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই ঘটনা নিছক ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিবিআই) বনাম একটি রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর সংঘাত নয়, কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরস্পরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক গালিগালাজও শুধু নয়। রবিবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া কলকাতার নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ বরং একটি অত্যন্ত গুরুতর সমস্যারই অশনি সংকেত আর সেটা হলো ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর (ফেডারেল স্ট্রাকচার) ওপর আসা হুমকি। ভারতের প্রায় তিরিশটি অঙ্গরাজ্য দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যে সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা, তার ভিতটাকে ধরেই যেন নাড়া দিয়েছে এই কলকাতার কড়চা। ভারতের সংবিধানে যদিও খুব স্পষ্ট করে বলা আছে শাসনব্যবস্থার কোন অংশ রাজ্য সরকার ও কোন অংশ কেন্দ্রীয় সরকার দেখবে (এবং কোন কোনটা উভয়েরই দায়িত্ব, অর্থাৎ যৌথ তালিকায়) তারপরও ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের এখতিয়ারের সীমা নিয়ে বাগবিতণ্ডা গত সত্তর বছরেও থামেনি। কেন্দ্রে যদি ধরা যাক ক দল ক্ষমতায় এবং কোনও রাজ্যে তাদের বিরোধী খ দল সরকারে রয়েছে তাহলে তো বিরোধ বরাবরই তুঙ্গে উঠে থাকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিভিন্ন রাজ্যে সরকারকে ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রের রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এস আর বোম্মাই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সে প্রক্রিয়া অনেক কঠিন হয়ে গেছে। এখন আর প্রধানমন্ত্রীর মর্জি হলেই অত সহজে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ছেঁটে ফেলা সহজ নয়। কিন্তু তারপরও রাজ্যকে বিড়ম্বনায় ফেলার অনেক হাতিয়ার এখনও কেন্দ্রের হাতে আছে আর মূলত সেই প্রশ্নটাকে ঘিরেই দিল্লির কুর্সিতে থাকা মোদি-অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন মমতা ব্যানার্জি। ভারতে আঞ্চলিকতার রাজনীতি করে বিভিন্ন প্রদেশে যে শক্তিগুলোর উত্থান, মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস তারই অন্যতম। ফলে যথারীতি তার এই জেহাদে তিনি পাশে পেয়েছেন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র এমনকি জম্মু-কাশ্মিরের বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিকেও। কিন্তু বিরোধীদের এই সম্মিলিত আন্দোলন কীভাবে ভারতের সংবিধানকে পর্যন্ত বিপন্ন করে তুলেছে? এখানে রইল তারই এক সংক্ষিপ্ত পোস্টমর্টেম। দারোগা আর কোতোয়াল যখন মুখোমুখি ভারতে সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই কাগজে-কলমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ একটি সংস্থা হলেও তারা যে আসলে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে সেটা কোনও গোপন কথা নয়। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত কয়েক বছর আগে সিবিআই-কে খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি বলে বর্ণনা করেছিল অর্থাৎ যারা নিজেরা ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারে না, সরকারের শেখানো বুলিই যাদের বলতে হয়। সেই সিবিআইয়ের একদল অফিসার রবিবার সন্ধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাংলোতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এসে হাজির হন। রাজীব কুমার ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের অফিসার, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। কিন্তু তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কাজ করছেন, কলকাতার পুলিশ-প্রধান হিসেবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীরও অতি আস্থাভাজন। এতটাই যে এর আগে যখন পশ্চিমবঙ্গে সারদা চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে ও তাতে নাম জড়িয়ে যায় অসংখ্য ছোট-বড় তৃণমূল নেতার, মমতা ব্যানার্জি এই রাজীব কুমারকেই দিয়েছিলেন এর তদন্ত ভার। রাজীব কুমারের সেই স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম ওই কেলেঙ্কারিতে এক বিদ্রোহী কুনাল ঘোষ ছাড়া কোনও তৃণমূল নেতারই সংশ্রব পায়নি, তা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই যখন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত হাতে নেয়, তারা এই রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপের অভিযোগ আনে বেরিয়ে পড়ে একটি গোপন লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভ উধাও হওয়ার রহস্য। কিন্তু রাজীব কুমারকে জেরা করার জন্য সিবিআইর উপর্যুপরি অনুরোধেও তিনি সাড়া দেননি, বরং বারবার এড়িয়ে গেছেন তাদের তলব। সিবিআইর বক্তব্য, সে কারণেই তারা বাধ্য হয়েছিল সটান পুলিশ কমিশনারের বাংলোতে হাজির হতে। কিন্তু এরপর কলকাতা পুলিশ তাদের বসকে রক্ষা করতে যেটা করে, তা স্বাধীন ভারতে আর কোনো দিন কোথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। তারা ওই সিবিআই কর্তাদের বাংলোতে ঢুকতে তো দেয়ইনি, টেনেহিঁচড়ে তাদের পুলিশের গাড়িতে তুলে কাছের থানাতেও নিয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েক আটক থাকার পরে ওই সিবিআই অফিসাররা থানা থেকে বেরোতে পারেন। ভারতে একটা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্য সরকার বা তাদের পুলিশেরই। কিন্তু সেই যুক্তিতে সেই দারোগারা যেভাবে কেন্দ্রের সিবিআই-বেশী কোতোয়ালদের পর্যন্ত পাকড়াও করে নিয়ে গেছেন, দিল্লিতে ভারত সরকারের নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের এখনও তা বিশ্বাস করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। তখনই অনুমান করা গিয়েছিল, এই সংকট আরও বড় আকার নেবে আর ঠিক হয়েছেও তা-ই। মেট্রো চ্যানেলে মমতার লাগাতার ধরনা কলকাতার প্রাণকেন্দ্র এসপ্ল্যানেডের কাছেই একটি জায়গার নাম মেট্রো চ্যানেল। প্রায় এক দশক আগে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে এখানেই ধরনায় বসেছিলেন তখনকার বিরোধী মমতা নেত্রী ব্যানার্জি যে আন্দোলনের পুঁজি তাকে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কুর্সিতে বসিয়েছিল বলে অনেকেরই বিশ্বাস। ক্ষমতায় আসার পর তিনি অবশ্য মেট্রো চ্যানেলে সব ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু রবিবার সিবিআই-কাণ্ডের পর সেই মমতা ব্যানার্জিই আবার কেন্দ্রের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ওই মেট্রো চ্যানেলে ধরনায় বসে পড়তে এক মুহূর্তও দেরি করেননি। সেখানে শুধু তার দলের সহকর্মীরাই নন, ধরনামঞ্চে যোগ দিয়েছেন কমিশনার রাজীব কুমার নিজে, সঙ্গে রাজ্য পুলিশের বড় কর্তারাও। মেট্রো চ্যানেলে কেন ধরনা, কলকাতার মেয়র ও মমতার ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফিরহাদ হাকিম তার জবাবে বলছেন, এটা রাজনৈতিক মঞ্চ নয়এটা হলো রাজ্যের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই! মমতা ব্যানার্জি ও তার সঙ্গীরা যা-ই বলুন, এই ধরনার রাজনীতি তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ধরনায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই একে একে তার দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ, ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো বহু বিরোধী নেতা। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী পর্যন্ত টুইট করেছেন, এই লড়াইয়ে আমরা মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে লড়বো। প্রশ্নটা হলো লড়াইটা ঠিক কিসের? জবাবে বলতে হয়, এই প্রতিবেদনের শুরুতেই যে কথা বলছিলাম মমতা ব্যানার্জি আসলে খুব সুকৌশলে এই লড়াইটাকে একটা কেন্দ্র বনাম রাজ্য চেহারা দিতে পেরেছেন। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআইকে পাঠিয়ে কেন্দ্র কি ঠিক করেছে? কিংবা নিজের পছন্দের পুলিশ কর্তাকে আড়াল করতে মুখ্যমন্ত্রীর ধরনায় বসা কি ঠিক হয়েছে? বাগবিতণ্ডা এখন চলছে এসব ইস্যুতে। দুমাস বাদেই ভারতের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা বিরোধী শিবিরে প্রধানমন্ত্রিত্বের অন্যতম দাবিদার মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক ভাগ্যে এই ঘটনার কী প্রভাব পড়বে তুমুল চর্চা চলছে তা নিয়েও। আর সেই কিছুটা স্পর্শকাতর, কিছুটা মুখরোচক বিতর্কের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে সারদা বা রোজ ভ্যালি চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির মূল অভিযোগটাই। রাজনৈতিক নেতাদের মদতে এসব প্রতারক সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে যে লাখ লাখ গরিব আমানতকারীর সারা জীবনের সঞ্চয় হাতিয়ে নিয়ে তাদের পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে, তাদের দীর্ঘশ্বাস শোনার জন্য আজ আর কেউ বসে নেই! সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন এইচ/২২:৫৪/০৫ ফেব্রুয়ারি



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2Gu80pI
February 06, 2019 at 04:55AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top