কলকাতা, ২৭ এপ্রিল- ভোটের বাজারে প্রার্থীদের ধরতে গেলে ভোরই ভাল। আসানসোল স্টেশনে যখন নামলাম, তখন ভোর নয়, সকাল। সকাল সাড়ে আটটা। বিজেপির বাবুল সুপ্রিয় আর তৃণমূলের মুনমুন সেনের কাছে আগে যাওয়া দরকার। আসানসোলের ভোটপ্রার্থী হওয়ার পর মুনমুন কলকাতা ছেড়ে এখানকার সিটি রেসিডেন্সি হোটেলকেই তাঁর ঘরবাড়ি বানিয়েছেন। স্টেশন থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে বুঝলাম, তার কোনও দরকার ছিল না। মুনমুন সেন তখনও ঘরে। অতএব লবিতে অপেক্ষা। মমতা ব্যানার্জি এবার মুনমুনকে আসানসোলে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি সুচিত্রা সেনের মেয়ে, সুশিক্ষিত, সুন্দরী, অভিনেত্রী। ২০১৪-য় বাঁকুড়া থেকে জয়ী সাংসদ। তাঁর মুকুটে অনেক পালক। বলতে গেলে, দেশে ভোট গরমের সময়েই হয়। ২০১৪-য় তাঁকে দেখেছি ঘেমেনেয়ে প্রচার করতে। এবার কী হচ্ছে তা বুঝতে সিটি রেসিডেন্সিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা। খানিকক্ষণ বাদে কর্নেল দীপ্তাংশু চৌধুরি এলেন। মুনমুনকে সাহায্য করতে এসেছেন। সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। কার্গিল যুদ্ধের পর স্বেচ্ছাবসর নিয়ে রাজনীতিতে। ২০১৬য় বিজেপির হয়ে আসানসোলে দাঁড়ান। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে। মমতা তাঁর হাতে দলের ডিজিটাল মিডিয়ার দায়িত্ব দেন। এখন আসানসোলের ভার কাঁধে। সুভদ্র আর সৌজন্যপরায়ণ মানুষটির ধৈর্য দেখবার মতো। মুনমুনের সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে এসেছেন, তাঁদের কাউকে চা, কাউকে কফি, কাউকে বা ফ্রেশ লাইম খাইয়ে ঠান্ডা রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দীপ্তাংশু। মুনমুন? দশটা বাজে সাড়ে দশটা বাজে, তবু তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই। সাড়ে এগারোটার পর মুনমুন নামলেন। অফ হোয়াইট শিফনের ওপর হালকা প্রিন্টেড শাড়ি, হাতে ছোট্ট ক্লাচ, ট্র্যান্সপ্যারেন্ট পাউচে ওয়েট টিস্যু-সহ আরও কতকী! সিঁথিতে সিঁদুর, বড় লাল টিপ, আলতো মেক-আপ, গাঢ় লিপস্টিকে তিনি আরও সুন্দরী। হোটেলের সুশীতল লবির বাইরে কাঠফাটা রোদে চোখ রেখে বললেন, স্কর্চিং সান। আয়াম জাস্ট রোস্টেড। দ্য হোল সিটি ইজ লাইক আ হট টাব। লোরেটো স্কুল, লোরেটো কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীর প্রতিটি শব্দ সত্যি। লবিতে এসে বললেন, এই গরমে বাইরে বেরিয়ে বড্ড টায়ার্ড হয়ে পড়ছি। জিজ্ঞেস করি, প্রচার কেমন চলছে? আমি বলে দিয়েছি, এই রোদে রোডশো করতে পারব না। আই পুট মাই ফুট ডাউন। ভোটভারতের রাস্তায় কাজে নেমে এতদিনে মনের মতো কথা শুনলাম! জিজ্ঞেস করি, এখন কোনদিকে যাবেন? বললেন, ওঁরা যেদিকে নিয়ে যাবেন, সেদিকে যাব। জানালেন, সকালে আড়াই ঘণ্টা আর সন্ধেয় আড়াই ঘণ্টা এই হল তাঁর প্রচাররুটিন। বাকিটা দীপ্তাংশু সামলাচ্ছেন তাঁর টিম নিয়ে। মমতা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাউকে কোনও কাজ দিলে, তিনি তাঁর সবটুকু দিয়ে সে কাজ করেন। দীপ্তাংশুও ব্যতিক্রম নন। গোটা বাংলার সব জায়গাতেই মমতার কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত। আসানসোলেও তাই। এখানে যাঁরা তৃণমূলের সমালোচনা করতে চান, তাঁরা মন্ত্রী মলয় ঘটক বা আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারির মতো অপেক্ষাকৃত নরম টার্গেটে তীর ছোঁড়েন। আর কীই-ই বা করার আছে তাঁদের! কেউ কেউ বলেন, মলয় আর জিতেন্দ্রর মধ্যে আড়ি আড়ি। শোনা যাচ্ছে, মেয়র মহোদয় নাকি চান মলয় ঘটকের বিধানসভা কেন্দ্রে মুনমুন হারুন। মলয় ঘটক চান, জিতেন্দ্র তেওয়ারির বিধানসভা কেন্দ্রে মুনমুন হারুন। এই দুটিই আসানসোল লোকসভার আওতায়। বোধ করি, কোনওটাই সত্যি নয়। মুনমুন বললেন, আমার কারও সঙ্গেই কোনও যুদ্ধ নেই। দীপ্তাংশুর কাজ সব পক্ষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা। যদি পক্ষ-প্রতিপক্ষ আদৌ থাকে। দীপ্তাংশুর নিজের ওপর আস্থা আছে। কারণ, ২০১৬-য় ১৬ দিন প্রচার করে আমি ৫৩ হাজার ভোট টেনেছিলাম। আসানসোলে তৃণমূলের তারা এসেছেন বিজেপির নক্ষত্রকে সামাল দিতে। বাবুল সুপ্রিয় বলিউডের পাঁচতারা গায়ক তো বটেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি রাজনীতির তারাও হয়েছেন। বটতলার মহিশীলা কলোনিতে তাঁর খোঁজে গেলাম। ২০১৪য় প্রার্থী হওয়ার পর তিনি এই অ্যাপার্টমেন্টটির চারতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। জেতার পর তিনি সেটি কিনে নেন। ফ্ল্যাটের সামনের ঘরটি এখন তাঁর ওয়ার রুম। আসানসোলের সব খুঁটিনাটি তাঁর ওয়ার-রুমের কম্পিউটারে বন্দি। ওয়ার-রুমে ১০১২ জন কাজ করেন। সব কিছু বাবুলের নখের ডগায়। দূরের প্রচার প্রায় সারা। আসানসোল শহরের কাছে যেসব জায়গা সেখানে যেতে হবে। সবার কাছে পৌঁছতে হবে। লছিপুর গেটে ছোট ছোট দোকান। গাড়ি থেকে নামতেই তাঁকে ঘিরে জটলা। কানে এল, এবারের ভোট-বাজারের সুপার-ডুপার হিট গান, এই তৃণমূল আর না। বাবুলের প্রচার গাড়ি থেকে তো এই গান বাজছে না! এই সুর কোথা থেকে আসছে? গবেষণায় কাজ নেই, গানটুকু থাক। লছিপুর থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছুটল জিটি রোড ধরে। একটা ঝুপড়ি দোকানের সামনে এসে বাবুল হাতজোড় করতেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বললেন, এখানে চা খেতেই হবে। ঝুপড়ি দোকানের বেঞ্চে বসে বাবুল ভাঁড়ের ধূমায়িত চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিলেন। সেখানে ভিড় জমাট বাঁধল। সবাই সেলফি তুলতে চান: আমার সঙ্গে, আমার সঙ্গে। প্রচণ্ড গরমে সবাই ঘেমেনেয়ে যাচ্ছেন। বাবুলও। এক কর্মী ভেতর থেকে টেবিল ফ্যান এনে প্লাগে গুঁজে দিলেন। আমি তো আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম , বাবুলের মন্তব্যে হাসির ফুলঝুরি ফুটল। আরও পথ যেতে হবে। বাবুল কখনও সরু ফিতের মতো রাস্তায় হাঁটছেন, কখনও গাড়ি থেকে হাত নাড়ছেন। আমাকে এবার যেতে হবে, সিপিএম প্রার্থী গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জির সম্পর্কে জানতে। গৌরাঙ্গ গরিব পরিবারের ছেলে। মজদুরের কাজ করে পড়াশোনা চালিয়েছেন। এমএ পাশ করার পর পার্টির নেতারা বললেন, তুই গরিবের কষ্ট জানিস। তুই পারবি তাদের জন্যে কাজ করতে। সেদিন থেকেই উখড়ার পার্টি অফিসে একটা ডাকটিকিট-আয়তনের ঘরে গৌরের বাস। সেই ঘুপচি ঘরে খাট, জরুরি জিনিস রাখার দেওয়াল আলমারি ছাড়া আছে তাঁর একান্ত সময়ের সঙ্গী বই। দলের আশা, পাণ্ডবেশ্বর, জামুড়িয়া, রানিগঞ্জে এখনও সিপিএম পোক্ত। আর দলের নিরাশার কারণ, গোটা বাংলায় পার্টির রক্তক্ষরণ চলছে। এ নিয়েই গৌরাঙ্গর ভোটপথে চলা। কংগ্রেসের ছবিটাও এমনই আঁধারি। বিশ্বরূপ মণ্ডল সেনাবাহিনীর জওয়ান ছিলেন। সেই স্পিরিট আজও কাজ করে অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক, চালিয়ে যেতে হবে লড়াই। তাঁর প্রচারে কংগ্রেসের কোনও নামী নেতার পা পড়েনি। তিনি সোমেন মিত্রকে বলেছিলেন, স্যর, আসুন না একটিবার। স্যর শোনেনি বা শুনতে পারেননি। আর/০৮:১৪/২৭ এপ্রিল



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://bit.ly/2IJrEAd
April 27, 2019 at 07:25PM
27 Apr 2019

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top