লন্ডন, ০৬ জুলাই- বাংলাদেশের ক্রিকেটে যার নাম থাকবে সোনা দিয়ে মোড়ানো, সেই মাশরাফি বিন মর্তুজার বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ। তাও পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে। তাই সেমিফাইনালের স্বপ্ন আগেই ভেঙে চুরমার হলেও, ক্রিকেট মক্কায় আজকের ম্যাচের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো বাংলাদেশ। সবার একটাই আশা ছিল, মাশরাফির বিশ্বকাপ বিদায়ের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারাবে প্রিয় জাতীয় দল। সেই সাথে পঞ্চম হয়ে দেশে ফিরবে টাইগাররা। বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও এক বুক আশা নিয়ে সেই কাঁক ডাকা ভোরে লন্ডনের নানা দিক থেকে সকাল সকাল চলে আসলেন লর্ডসে। অথচ বিপরীত চিত্র ছিল পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমে। এ ম্যাচ জয়ের ব্যাপারে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের আত্মবিশ্বাস আর আস্থা- দুইই হয়ত কম ছিল। তাই আজ সেই সাত সকাল থেকে বিশ্বকাপ কভার করতে আসা প্রায় জন তিরিশেক পাকিস্তানি সাংবাদিক বহরের মূল অংশটা প্রায় সারা দিন লর্ডসের প্রেস বক্সের বাইরে এদিক-ওদিক ঘুরেই কাটালেন। প্রেসবক্স লাগোয়া ডাইনিংয়ে এটা ওটা খেয়ে আর চা-কফি পানে ব্যস্ত থাকলেন সবাই। লেখালিখি করলেন হাতে গোনা কজন। অথচ দিন শেষে তাদের দল পাকিস্তানই হাসলো শেষ হাসি। আর সকালের সেশনে লক্ষ্যহীন বোলিং, যাচ্ছেতাই ফিল্ডিংয়ের পর আবারও দায়িত্বহীন ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী ঘটাল টাইগাররা। ফলে ৯৪ রানের বড় পরাজয়ে মাঠ ছাড়লো দল। সাকিবের ৭৭ বলে ৬৪ রানের ইনিংসটি বাদ দিলে তামিম, সৌম্য, মুশফিক, লিটন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা ব্যর্থতার মিছিল করলেন। শেষ পর্যন্ত গিয়ে ৯৪ রানের বড় পরাজয় সঙ্গী হয়ে থাকলো। ২ জুন এ লন্ডন শহরেরই আরেক অভিজাত ভেন্যু ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বপ্ন যাত্রার। দেশ ও জাতি আশার প্রহর গুনছিলেন এবার বুঝি প্রিয় জাতীয় দল প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলবে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে সমানকালে লড়েও শেষ মুহূর্তে গিয়ে না পারা আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বৃষ্টিতে জয়ের বদলে এক পয়েন্ট পাওয়ায় খানিক ছন্দপতন। তারপর আবার নিজেদের ফিরে পাওয়া। টনটনে ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আবার কক্ষপথে আসা। মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ঠিক এক মাস পর ২ জুলাই ভারতের সঙ্গে ২৮ রানের হারেই সব স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে গেছে। শুক্রবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল আসলে সান্ত্বনার, জয় দিয়ে শেষ করার। কথায় বলে না, সব ভাল তার শেষ ভাল যার। আসলে সেটাই ছিল শেষ প্রত্যাশা। কিন্তু হায়! সেটাও পূর্ণ হলো না। বরং শেষ ম্যাচে গিয়ে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বাজে পরিণতি হলো। অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের হিমালয় সমান স্কোরের নিচেও সেভাবে চাপা পড়তে হয়নি। পাল্টা ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৩৩ রানের বড়সড় স্কোর গড়েছিল মাশরাফির দল। এমনকি ভারতের সঙ্গে সাকিব আর সাইফউদ্দিন ছাড়া আর কেউ কিছু করতে না পারলেও ব্যবধান আজকের মত এত বড় হয়নি। কিন্তু ব্যবধানগত তারতম্যে এবারের বিশ্বকাপে অন্যতম বড় হার হলো শেষ ম্যাচে। সেটাই শেষ কথা নয়। পুরো বিশ্বকাপে সবচেয়ে, অনুজ্জ্বল ব্যাটিং প্রদর্শনীও হলো আজ ক্রিকেট মক্কায়। এই এক হারে সেরা পাঁচ দলেও থাকা হলো না। এখন সম্ভবত অবস্থান দাঁড়াবে সাতে। কাজেই অবস্থানগত দিক থেকে আগের মতই। সেটাই শেষ কথা নয়। জয়ের সংখ্যা আর আর বড় দলকে হারানোর মানদন্ডেও কিন্তু শেষ পরিণতিটা আগের মতই। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে সেই ২০০৭, ২০১১ আর ২০১৫ সালেও বাংলাদেশ তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল। আর এবার শুরুতে অনেক কিছু হবে বলে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত ২০১৯এ সেই তিন জয় নিয়েই দেশে ফেরত যেতে হবে টাইগারদের। এছাড়া বড় দলকে হারানোর হিসেব নিকেশটাও ২০০৭র মতই। সেবারও ভারতকে হারিয়ে শুরু করা বাংলাদেশ সেরা আটের লড়াইয়ে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জিতেছিল। এবারও ঘুরে ফিরে ঠিক দুই বড় দল দক্ষিণ আফ্রিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারনোই সার হয়ে থাকলো। বোনাস বলতে সাকিবের অবিস্মরণীয় অলরাউন্ডিং নৈপুণ্য, ৬০৬ রান আর ১১ উইকেট। নির্মম সত্য হলো, অনেক সম্ভাবনায় শুরু করা মাশরাফির দল শেষ করলো আগের জায়গায়ই। এ কঠিন সত্যটা আরও শেলের মত বিধলো যখন, প্রেস কনফারেন্সে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক মাশরাফিকে প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা আপনার দল তো সাত নম্বরই হলো, আপনি কিভাবে দেখছেন? বিশ্বকাপে এটাই ছিল তার শেষ ম্যাচ। আর এ ম্যাচটি হতে পারতো জয় দিয়ে এবং প্রথমবার পঞ্চম হয়ে বিশ্বকাপ শেষ করার তিন। কিন্তু তাও হলো না। বরং আজকের ম্যাচে তার দলের পারফরমেন্স আরও অনুজ্জ্বল-শ্রিহীন মনে হয়েছে। মাঠে পাকিস্তানিদের যতটা জিততে মরিয়া, উদ্যমী আর দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ মনে হয়েছে, বাংলাদেশকে ততটা মনে হয়নি। পাকিস্তানকে হারনোর জন্য যে উদ্যম, দৃঢ় সংকল্প এবং বাসনা প্রয়োজন ছিল- তাও ছিল কম। বরং ক্রিকেটারদের মনের দিক থেকে কেমন যেন দুর্বল মনে হয়েছে। কেনই বা আজ পারফরমেন্স হলো আরও বেশি খারাপ? এ দুই প্রশ্নের জবাবে মাশরাফির আকার ইঙ্গিতে স্বীকার করেছেন, তার দলের মনের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। এভাবে শেষ করার কথা হয়ত তিনিও ভাবেননি। তাই মুখে এমন কথা, এমন সমাপ্তি হতাশার অবশ্যই। তবে তার নিজের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ বলে বেশি হতাশ এমন নয়। তার ভাষায়, তবে আমার নিজের কোন আক্ষেপ নেই। মাশরাফির অনুভব, এ ম্যাচের আগেই হয়ত তার দল খানিক হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ভারতের সঙ্গে হারের কারণে সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন ভঙ্গের পর ক্রিকেটারদের মধ্যে এক রকমের হতাশা চলে আসে। ভাল খেলার উদ্যম, অনুপ্রেরণাও যায় কমে। মোদ্দা কথা দলের মনোবল আগে যতটা চাঙা ছিল, ভারতের কাছে হেরে সেমিতে খেলার আশা শেষ হবার পর সেই মনোবলে চির ধরেছে। সেই ক্ষয়িষ্ণু মনোবল নিয়ে আজকের ম্যাচ খেলতে নামায় পারফমেন্স আরও বেশি খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, আসলে আজকের ম্যাচ জিতলে পাঁচে যেতাম। তবে ভারতের সাথে আগের ম্যাচের হারের পর মনোবল গেছে কমে। আর সেমিফাইনালের স্বপ্ন ও আশা শেষ হবার পর ভাল খেলাও কঠিন। কিন্তু পাকিস্তানও তো সেমিফাইনালের স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়েই আজ খেলতে নেমেছিল। কই তাদের তো হতোদ্যম মনে হয়নি। মাশরাফির ব্যাখ্যা, আমরা আগের ম্যাচে ভারতের কাছে হারের হতাশা নিয়ে মাঠে নামলেও পাকিস্তানিরা বরং ছন্দেই ছিল। তারা আজ মাঠে নেমেছিল আগের ম্যাচ জয়ের সুখস্মৃতি ও অনুপ্রেরণা নিয়ে। তার অনুভব, যেহেতু পাঁচ নম্বরে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করার সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল, তাই চেষ্টায় কমতি ছিল না কারোই। তবে জায়গামত করণীয় কাজগুলো হয়নি। সামগ্রিক পারফরমেন্সের একটা চালচিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মাশরাফি জের টানেন এভাবে, ব্যাটিংটা ভালই হয়েছে। আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে আমাদের ব্যাটিং সামর্থ্য আছে। আমরা ৩০০+ রান করতে পারি। তবে বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে রাজ্যের হতাশ বাংলাদেশ অধিনায়ক। তার ভাষায় বোলিংটা ভাল হয়নি। আর ফিল্ডিং আরও খারাপ হয়েছে। বোলিংটা কেমন খারাপ হয়েছে? ব্যাখ্যায় গিয়ে মাশরাফি নিজের কাঁধে দায় দায়িত্ব নিয়ে বলেন, আমরা নতুন বলে এবং প্রথম ১০-১৫ ওভারে যেমন বোলিং করা দরকার, তা পারিনি। না পেরেছি উইকেট নিতে, না প্রয়োজনীয় সময় ব্রেক থ্রু আনতে। আর সবচেয়ে যেটা ভুগিয়েছে, তা হলো- যখন প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা কোন জুটি গড়েছেন, তখন আমরা বাজে বল করেছি। ঐ সময় ব্যাটসম্যানদের ওপর চেপে বসার বদলে আমরা আরও ডাউন হয়ে পড়েছি। সূত্র: জাগোনিউজ আর/০৮:১৪/০৬ জুলাই



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2Yz5EMt
July 06, 2019 at 04:49AM
06 Jul 2019

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top