ঢাকা, ২৪ অক্টোবর- তিন পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ইসমাইল হায়দার মল্লিক ও খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গড়ে উঠেছে এক চক্র। বিসিবির সব আর্থিক লেনদেন, টেন্ডারবাজি, টুর্নামেন্ট পরিচালনা থেকে শুরু করে ঘরোয়া লিগের যত অনিয়ম-দুর্নীতি সব সম্পন্ন হয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই চক্রের হাতেই এখন জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের ক্রিকেট। ক্ষমতাধর তিন বোর্ড পরিচালক সব প্রশাসনিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করছেন, আর ক্লাবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ তথা মাঠের ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ওবায়েদ নিজাম, ওমর হোসেন রতন, জিকরুল হাসান আকাশ, সয়লাব হোসেন টুটুল, আজিজুর রহমান, আলী হোসেন, সাইফুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মুজিবর রহমান, তানভীর আহমেদ প্রমুখ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও বিএনপি-জামায়াতের এই চক্রই এখন বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে সুকৌশলে। যাতে পাইপলাইনে ভালো ক্রিকেটার না থাকে এবং জাতীয় দলের সাফল্য মুখ থুবড়ে পড়ে। সাফল্যে প্রভাব পড়ছেও। বাংলাদেশের পছন্দের ফরম্যাট ওয়ানডেতে যেখানে ২০১৮ সালে সাফল্যের হার ছিল ৬৫.০০ ভাগ (২০ ম্যাচে ১৩ জয়) সেখানে ২০১৯ সালে নেমে এসেছে ৩৮.৮৯ ভাগে (১৮ ম্যাচে মাত্র ৭ জয়)। টেস্টে অবস্থা খুবই ভয়াবহ! ২০১৮ সালে যেখানে সাফল্যের হার ছিল ৩৭.৫ ভাগ (৮ ম্যাচে ৩ জয় ১ ড্র) সেখানে চলতি বছরে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে (৩ ম্যাচে ৩ হার)। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন যেন সব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন! ত্যাগী ক্রিকেট সংগঠকদের ক্লাবগুলোকে জোর করে রেলিগেশনে নামিয়ে দিয়ে তাদেরকে এখন বোর্ড থেকেও বিতারিত করা হয়েছে! তবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যারা এখনো টিকে আছেন তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। বিসিবি পরিচালক হিসেবে থাকলেও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির মতো ত্যাগী সংগঠকদের যুক্ত করা হয় না বোর্ডের কার্যক্রমে। বোর্ডের নানা স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ক্রিকেটারদের ধর্মঘটের মতো নানা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষোভের আগুন জ্বলছে সবার মাঝে। গতকাল এ প্রতিবেদককে আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি বলেন, ক্যাসিনো কা- থেকে শুরু করে এই যে নানা রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণ ত্যাগী সংগঠক না থাকায়। কেউ অভিমানে ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কাউকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। বোর্ডের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগে গড়ে ওঠা চক্র বিসিবি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে একদিকে যেমন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, অন্যদিকে তেমনি ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছেন। এই সিন্ডিকেটের কাজ হচ্ছে, লিগের ক্লাবগুলোকে কিনে নেওয়া, আর কিছু ক্লাবকে রেলিগেশনে নামিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আর ক্লাব নিয়ন্ত্রণে থাকলে সংগরিষ্ঠতা তাদের থাকবে, তাই ক্রিকেট বোর্ডও নিয়ন্ত্রণে থাকবে, আর বোর্ড নিয়ন্ত্রণে থাকলে আর্থিক এই কাজগুলো তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। বিসিবির টিভি রাইটস, প্যারামিটার বোর্ড, গ্রাউন্ডসের সব স্বত্বসহ যাবতীয় সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন এই চক্র। পূর্বাচলে বিসিবি নিজেদের অর্থায়নে বিশাল বাজেটের যে নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করছে সেখানকার নিয়ন্ত্রণেও এই সিন্ডিকেট। বিসিবি ও ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি এই চক্র দেশ বিরোধী নানা অবৈধ কাজের সঙ্গেও যুক্ত। তার বড় প্রমাণ তো ক্যাসিনোর রাজা লোকমান হোসেন ভূঁইয়া নিজেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান লোকমান ক্রিকেট বোর্ডের ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন স্বয়ং বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের হাত ধরে। বিসিবির ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান এবং আম্পায়ার্স বিভাগেও সহসভাপতি এই লোকমান। চক্রের প্রধান ব্যক্তি ইসমাইল হায়দার মল্লিক, যিনি এক সময় ছিলেন নাজমুল হাসান পাপনের ব্যক্তিগত সহকারী। ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও নাজমুল হাসান বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর মল্লিকও বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। বিসিবির ফিন্যান্স বিভাগ ও লজিস্টিক অ্যান্ড প্রটোকল বিভাগের চেয়ারম্যান তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) গভর্নিং কাউন্সিলেরও সর্বেসর্বা এই মল্লিক। মার্কেটিং ও কমার্শিয়াল বিভাগেও সহসভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে মল্লিককে। বিসিবির আর্থিক বিষয়াদির সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন মল্লিকের হাতে। খালেদ মাহমুদ সুজন, বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান। হাইপারফরম্যান্সেরও ভাইস চেয়ারম্যান। ক্রিকেটের উন্নয়নের একটা গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে। বিএনপি ঘরানার বলে পরিচিত জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক ক্রিকেটের উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা তো দূরের কথা ক্লাব ক্রিকেট ধ্বংসের অন্যতম হোতা! অভিযোগ আছে, মোহাম্মদ আশরাফুলকে ফিক্সারদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই খালেদ মাহমুদই। তিনি ছিলেন বিএনপি সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে বাংলাদেশ দল যখন একের পর এক ম্যাচ হারছিল তখন ভারপ্রাপ্ত কোচ হিসেবে দলের সঙ্গে যাওয়া খালেদ মাহমুদ তখন ক্যাসিনো নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। খালেদ মাহমুদের ক্যাসিনোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। চক্রের অন্যতম সদস্য ওবায়েদ নিজাম। যিনি বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতাকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট আলী আসগর লবির আমলে প্রভাবশালী ক্লাব কাউন্সিলর ছিলেন। আরাফাত রহমান কোকোর ক্লাব ওল্ড ডিওএইচএসের সেক্রেটারি। ২০০৩ সালে তিনি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। কোকোর ঘনিষ্ঠ ৭ বন্ধুর মধ্যে একজন এই ওবায়েদ নিজাম। তার আরেক পরিচয় বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমানের ছেলে শায়ান এফ রহমানের বন্ধু। জিকরুল আকাশ ছিলেন জিয়া চিকিৎসক পরিষদের সদস্য। হলি ফ্যামিলিতে চাকরি করতেন। বিএনপি আমলের ক্ষমতাধর ডাক্তার। ক্রিকেট কিংবা ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তিনি মল্লিকের বন্ধু কোটায় বিসিবিতে এসেছেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা এই আকাশ এখন তিনি বিসিবিতে আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তানভীর আহমেদ মূলত বেক্সিমকোর মালিকানাধীন দলগুলো দেখাশোনা করেন। কয়েক বছর আগেও তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। কোনো রকমে খেয়ে পরে বেছে থাকতেন। চক্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এখন তিনি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ মিলে তিনি একাই দেখাশোনা করেন মোট ১০টি ক্লাব। ওমর হোসেন রতন থাকতেন কলাবাগানের এক মেসে। এক সময় কলাবাগান ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই ওমর রতন ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পুলিং এজেন্ট হিসেবে কলাবাগান লেক সার্কাস গার্লস স্কুল কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি মল্লিকের চুলকাটার দোকানের ম্যানেজারের চাকুরি নেন। সেখান থেকে মল্লিক তাকে নিজেদের ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত করেন। চক্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় তার নিজস্ব দুটি ফ্লাট আছে, বাড়ির জায়গা কিনেছেন এবং আরও অনেক সম্পত্তি তার নামে। চক্রের আরেক সদস্য গোপীবাগের সাইফুল ইসলামও ছিলেন আরাফাত রহমান কোকোর আস্থাভাজন। ২০০৩ সালের শুরুতে কোকোর দল ওল্ড ডিওএইচএসের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে বিএনপি-জামায়াতের আমলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সাইফুল এখন মল্লিকের হাত ধরে বিসিবিতে সদর্পে পুনর্বাসিত। আলী হোসেন হচ্ছেন ক্রিকেট কমিটি অব মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) সদস্য সচিব। অথচ আলী আসগর লবি বোর্ডের সভাপতি থাকাকালীন ছিলেন বোর্ডে দাপুটে ব্যক্তি। ডেভেলপমেন্ট কমিটি, টুর্নামেন্ট কমিটি ও টিকিট কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। এই চক্রে আম্পায়ারিং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন আম্পায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও আম্পায়ার্স কমিটির সদস্য সচিব সয়লাব হোসেন টুটুল ও কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুজিবর রহমান। দুজনই বিএনপির সক্রিয় সদস্য। টুটুল এখনো বিএনপির ক্রীড়া উন্নয়ন পরিষদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। মুজিবর রহমান হচ্ছে বিএনপি আইনজীবী ফোরামের সদস্য। বিএনপি-জামায়াতের এই চক্র বোর্ডে এবং ক্রিকেটার তৈরির আঁতুড়ঘর ক্লাব ক্রিকেটে এতটাই বেশি প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সংগঠক বলেন, আওয়ামী লীগের ত্যাগী লিডার জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমানের ছেলে হয়েও নাজমুল হাসান পাপন বিএনপির লোকদের বোর্ডে ক্ষমতা দিয়ে বসে আছেন। যারা ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই চক্রই দেশের ক্রিকেটকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। হয়তো পাপন সাহেব টেরও পাচ্ছেন না, নয়তো বুঝে শুনেই সব কিছু করছেন। ক্রিকেটের চেয়েও কি পাপন সাহেবের কাছে ক্ষমতা বড়? আমাদের একটাই চাওয়া ক্রিকেট এই চক্রের হাত থেকে মুক্তি পাক। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন আর/০৮:১৪/২৪ অক্টোবর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/32ItJTn
October 24, 2019 at 05:50AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top