রোম, ১৫ মার্চ- বিশ্বজুড়ে মহামারী আকারে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কেন্দ্র হয়ে ওঠা ইতালি থেকে দলে দলে ফিরছেন বাংলাদেশিরা, দৃশ্যত অবরুদ্ধ ইতালিতে এখন কেমন চলছে জনজীবন তা তুলে ধরেছেন সেখানে বসবাসরত রাকবীর হাসান। ইতালির যে অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি সেই ভেনোতোর পাশের ফ্রিউলি ভেনেৎসিয়া জুলিয়া রিজিওনের পর্দেননে রাকবীরের বসবাস। আমি ভেনিস থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকি। তাই রোজ ট্রেনে করেই যাওয়া আসা করতাম। গত ২১ ফেব্রুয়ারি যখন ভেনিস থেকে ফিরছি তখনও ভুলক্রমেও মনের মধ্যে এমন ধারণা উঁকি দেয়নি যে, প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফেরা হবে না অনির্দিষ্টকালের জন্য, দেখতে দেখতে একঘেঁয়ে লাগা নয়নাভিরাম ভেনিস শহরেও আপাতত আর ফেরা হবে না। রাকবীর জানান, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরের পর হঠাৎ খবর পান লম্বার্দি অঞ্চলের লদি জেলার কদইনিঁও নামক শহরে আর ভেনোতো অঞ্চলের পাদুয়া জেলার ভো শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এর পর লম্বার্দি ও ভেনোতো অঞ্চলের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৫ মার্চ পর্যন্ত । তারপরেও পরিস্থিতি যে এত দ্রুত খারাপ হবে তা হয়ত কেউই ভাবেনি। কেউ কেউ বরং প্রসাশনকে একহাত নিয়েছে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য। জনশূন্য ভেনিসের সেন্ট মার্কস স্কয়ার, যেখানে স্বাভাবিক সময়ে থাকে পর্যটকদের ভিড়জনশূন্য ভেনিসের সেন্ট মার্কস স্কয়ার, যেখানে স্বাভাবিক সময়ে থাকে পর্যটকদের ভিড়এরপরে অতি সংক্রামক করোনাভাইরাসের বিস্তার ক্রমশ বাড়তে থাকায় ৮ মার্চ থেকে পুরো ইতালিকে রেড জোন ঘোষণা করে এক অর্থে ছয় কোটি মানুষকেই কোয়ারেন্টিন করা হয়। তার তিন দিনের মাথায় প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন ওষুধ, খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদির দোকান, পেট্রোল পাম্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা এবং ব্যাংক ও আর্থিক সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ কারখানা ছাড়া সব বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্যত এখন পুরো ইতালি তালাবদ্ধ। কারফিউয়ের মতোই জনসাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, স্থানীয় পার্কগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন জরুরি প্রয়োজন যেমন, কাজে যাওয়া, ডাক্তারের কাছে বা ফার্মেসিতে যাওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার করা ইত্যাদি কারণে বাসা থেকে বের হতে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হচ্ছে। কেউ কেউ একে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন বললেও প্রায় সবাই ব্যাপকহারে নিয়ম মেনে চলছে বলে জানান রাকবীর। তিনি বলেন, অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে বহু মানুষ সবাইকে নিয়ম মেনে চলার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত একে অপরের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। আবার কিছু মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই বাইরে বের হচ্ছেন। প্রথম দুই দিনেই দুই হাজারের বেশি মানুষকে পুলিশ জরিমানা করেছে এবং মিথ্যা ঘোষণার অপরাধে তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও এর বাইরে নয় জানিয়ে রাকবীর বলেন, বড় অংশের বাংলাদেশিরা এখানে যেসব প্রতিষ্ঠান বা কল কারখানাগুলোতে কাজ করেন সেগুলো এখনও সচল থাকায় অনেককেই এখনও কাজে যেতে হচ্ছে। তাতে কারও কারও মনে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। আবার যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই তাদের ব্যাপক উৎকন্ঠা নিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের উপর ভরসা করতে হচ্ছে। রাকবীর জানান, আপাতত খাবারের তেমন সংকটের কথা শোনা যায়নি। তবে বাংলাদেশিরা খাবারের জন্য মূলত স্বদেশিদের মুদি দোকানগুলোর উপরেই নির্ভরশীল যেখানে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়। এ সব দোকান আমদানিনির্ভর হওয়ায় সংকটের ঝুঁকি রয়ে গেছে। কোনো কোনো দোকানে এরইমধ্যে কিছু আলামত বিশেষ করে চালের সংকট দেখা গেছে। বাংলাদেশিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মূলত মুদি দোকান ও মানি ট্রান্সফার এজেন্সি জানিয়ে তিনি বলেন, এ দুটোই আপাতত বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত হওয়ায় ব্যবসায়ীরা কিছুটা ভারমুক্ত হলেও মুদি দোকান বাদে অন্য দোকানগুলোতে খদ্দেরের উপস্থিতি হাতেগোনা। আর সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হলেও কীভাবে, কাদের এবং কী পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হবে তা এখনও বলা না হওয়ায় আতঙ্ক রয়েছে তাদের মধ্যে। রাকবীরের মতে, এই দুর্যোগে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। বিশেষ করে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সবাই এখন কম-বেশি সতর্ক। বার বার সরকারের পক্ষ থেকে ঘরে নাগরিকদের থাকতে জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ আপাতত এটাকেই একমাত্র সমাধান মনে করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত বেডের সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাপক সংখ্যক লোককে জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া এরইমধ্যে বেড ও কৃত্রিম ভেন্টিলেটরের সংকট দেখে দিয়েছে। সবচেয়ে সংকটপূর্ণ অবস্থায় আছে লম্বার্দি অঞ্চলের বেরগামো জেলা। সেখানকার পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, চিকিৎসকদের যুদ্ধাবস্থার মতো বেছে বেছে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই অঞ্চলে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল বানানোর চিন্তা থেকে সরকার আপাতত সরে এসেছে ডাক্তার-নার্স সংকটের কারণে। সে কারণে রোগীর অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে হাসপাতালে না নিয়ে বাসায় চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসের বিস্তারে লাগাম টানতে না পারলে আগামী ১৮ মার্চের দিকে ইতালিতে সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে সরকার পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের হিসাবে, এ সময় প্রতিদিন গড়ে চার হাজারেরও বেশি মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হতে পারে। দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এপ্রিলের শেষ নাগাদ ৯২ হাজারের মতো হতে পারে। আর মোট তিন লাখ ৯০ হাজার মানুষকে প্রত্যক্ষ কোয়ারেন্টিনে রাখার প্রয়োজন পড়বে। মোট মৃতের সংখ্যা তিন হাজারে পৌঁছাতে পারে। ১৮, ১৯ মার্চের পর নতুন সংক্রমণ কমতে শুরু করবে এবং এপ্রিলের শেষের দিকে এসে নতুন রোগীর সংখ্যা এক অংকে নেমে আসবে বলে ইতালি কর্তৃপক্ষের ধারণা। এই বিপদের মধ্যে মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বেড়েছে বলেই মনে করছেন রাকবীর। গতকাল বিকেলে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ফেইসবুকে ইভেন্ট খুলে সবাই বাড়ির বারান্দায় এসে একযোগে জাতীয় সংগীতসহ উজ্জীবনী গান গেয়ে মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। দেশি- বিদেশি সকলে মিলে একযোগে সুদিন ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা করছেন। এম এন / ১৫ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/3cZzDF9
March 15, 2020 at 07:05AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন