নজরুল সঙ্গীত শিল্পী, সংগঠক ও গবেষক সুজিত মোস্তফা বাংলাদেশের ক্লাসিকাল সুরের জগতে সুপরিচিত এক নাম। বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, কবি ও সাহিত্যিক মরহুম আবু হেনা মোস্তফা কামালের সন্তান তিনি। এছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনে দেশবরেণ্য নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের স্বামীও তিনি। এই শিল্পমনা দম্পতির সন্তান অপরাজিতাও বেড়ে উঠেছে একজন কত্থক শিল্পী হিসেবে। নজরুলের গানকে গণমানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে দীর্ঘদিন যাবত নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন সুজিত মোস্তফা। বাংলাদেশে নজরুল সঙ্গীতের শুদ্ধচর্চা, বিকাশ ও প্রসারে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। গায়ক হিসেবে গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতের শিক্ষা ও সমালোচনায় নিয়মিত কাজ করেন। সম্প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশীদের আমন্ত্রণে সিডনিতে সঙ্গীতসন্ধ্যায় অংশ নিতে এসেছিলেন এই গুণী শিল্পী। তাঁর এই অস্ট্রেলিয়া সফরকালে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাতকার নিতে একত্রিত হয়েছিলেন সিডনি থেকে প্রকাশিত পাঠকনন্দিত কমিউনিটি পত্রিকা প্রভাতফেরীর প্রকাশক সোলায়মান দেওয়ান ও প্রধান সম্পাদক শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী। এই সময় উপস্থিত ছিলেন আনিসুর রহমান, রাহুল হাসান, মোখলেসুর রহমান (মুকুল), নিগার আফরোজা, মিসেস ফিরোজা, মিসেস লাভলী সহ আরো অনেকে। শিল্পী সুজিত মোস্তফার সাথে এ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মানবজীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির কথা ও নানা মন্তব্য। প্রভাতফেরীর পাঠকদের জন্য এখানে শিল্পী সুজিত মোস্তফার পুরো সাক্ষাতকারটি প্রকাশ করা হলো। প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ার সুপরিচিত শহর সিডনিতে আপনাকে স্বাগতম। পাঠকদের পক্ষ থেকে প্রথমেই আমরা জানতে চাই, আপনি কেমন আছেন? সিডনিতে এসে আপনার কেমন লাগছে। উত্তর: সিডনি আমি আগেও এসেছিলাম। বারো বৎসর আগে। সস্ত্রীক, এবং আমার কন্যা সহ, আমরা তিনজন মিলে পারফর্ম করেছিলাম। সেবার অবশ্য আমার ক্যানবেরা এবং ব্রিসবেনেও প্রোগ্রাম ছিলো। এবার শুধু সিডনি আর ক্যানবেরা। এবার আমার মনে হয়েছে সিডনি আগের চেয়ে কিছুটা ক্রাউডেড হয়েছে। কিন্তু আগে অল্প বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ হয়েছিলো, এবার সে তুলনায় অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। যে আমাকে ইনভাইট করেছিলো, তার সাথে আমার দেখাই হলো পয়তাল্লিশ বছর পরে। ফেইসবুকের মাধ্যমে তার সাথে প্রথমে যোগাযোগ হলো। এছাড়াও এবারের ট্যুরটি অন্য একটি কারণেও আমার কাছে অনেক গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে আসার আগে আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। আমার একটা ব্রনকিয়াল স্পাজম হয়েছিলো। আমি কথাই বলতে পারছিলাম না ঠিকমতো। যেহেতু আমার গান গাইতে হবে, আমি সাধারণত গলার সমস্যায় ডাক্তারদের কাছে যাইনা কারণ আমি নিজেই গলার ডাক্তারি করি। বাংলাদেশে ভয়েস কালচারের পাইওনিয়ারদের মাঝে আমি একজন। তাই আমি ভাবতে পারিনি যে আমার কোন সমস্যা হবে। কিন্তু যখন দেখলাম যে আমাকে গাইতে হবে, তখন পিজির নাককানগলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর কামরুল হাসানের কাছে গেলাম। উনিও মিউজিশিয়ানদের নিয়ে কাজ করেন। আমার অবস্থা দেখে উনি আমার একটা ফরম্যাট চেঞ্জ করে দিলেন। যেগুলো নিতে নিতে এখানে আসলাম। মাঝখানে কয়দিন একটু বিশ্রাম নেয়ার কারণে এখন গলা ঠিক হয়েছে। আমি তো কমার্শিয়াল সিঙ্গার না। আমি গান করি ভালোবাসা থেকে, প্যাশন থেকে। এ নিয়ে যে আমি বিরাট তারকা হয়ে যাবো, বা বিরাট নাম করবো এরকম ভাবনা নেই। ওয়েল, নাম হয়ে গেলে তো অবশ্যই ভালো লাগে। কিন্তু ঐ ভাবনা থেকে কাজ করিনা। আমি গানটা করি ভালোবাসা থেকে। প্রশ্ন: এবার সিডনিতে যে অনুষ্ঠানগুলোতে পারফর্ম করলেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা আমাদেরকে কিছুটা জানাবেন কি? উত্তর: এইখানে এবার এসে, যেহেতু হলটা একটু দূরে, এবং একই সাথে আরো কিছু প্রোগ্রামের ব্যবস্থা ছিলো, তাই পুরো হলভর্তি শ্রোতা পাইনি। কিন্তু যে শ্রোতাদেরকে পেয়েছি তারা হলেন ফ্যান্টাসটিক একটা ক্রাউড। তাছাড়া আমার গান করার স্টাইলটাও একটু অন্যরকম। অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড, আমি ইন্টারএকটিভ পারফর্ম করি। অনুষ্ঠানে আমি মানুষের সঙ্গে গল্প করি, গান নিয়ে কথা বলি, কৌতুক করি। আমি জীবন সম্বন্ধে কথা বলি, গানের হিস্ট্রি ব্যাখ্যা করি। এরকম টুকটাক টুকটাক যখন করেছি, তখন এই অনুষ্ঠানগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং শো হয়েছে। আমার শ্রোতারা যে খুবই উপভোগ করেছেন সেটা আমি বুঝেছি। ইন ফ্যাক্ট আমি তাদের থেকে বেশিই উপভোগ করেছি। প্রশ্ন: এবারের সিডনি ভ্রমণে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চিন্তাগুলো নিয়ে কিছু বলবেন? উত্তর: এবার এসে অনেকের সাথে দেখা হলো। যেমন, রাহুল আমার অনেক পুরনো ছাত্র। সে ঠিক ছাত্র না, রাহুল আসলে আমার সন্তান। ও এবং ওর বউ, দুজনেই। লাভলীর সঙ্গে আজ দেখা হলো বহুবছর পর। ইউনিভার্সিটি থেকে যখন বেরিয়ে গেলাম, দিল্লী ও শান্তিনিকেতন চলে গেলাম, তারপর আর দেখা হয়নি। পুরনো ফ্রেন্ড সার্কেলের সঙ্গে মেশা হলো। আরেকটা জিনিস আমি বুঝেছি। যতই হিপহপ, রক, ধুমধাড়াক্কা গানের ডামাডোল থাক না কেন, যদি গান ভালো গাওয়া হয় তাহলে শ্রোতা নিবিষ্ট হবেই। কিন্তু গানের একটা বড় সমস্যা হলো, গ্রস সিঙ্গিং এবং খুব ভালো সিঙ্গিং এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোন জায়গা দিয়ে মানুষকে কনভিন্স করা যায় না। সো লাকিলি, আমার মনে হয় যে এবার আমার গানগুলো বেশ ভালো হয়ে গেছে। খুব ভালো বলবো না, তবে তৃপ্তি পেয়েছি। যে কারণে আমি অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। একটা সিগনিফিকেন্ট ব্যাপার হলো আমার সারাজীবনে যতো পাবলিসিটি হয়নি তার চেয়ে বেশি পাবলিসিটি আমি সিডনি থেকে পেয়েছি। এটা আসলেই আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো। এখানে এতো সমঝদার শ্রোতারা থাকবেন আমি ভাবিনি। এখন আমাকে অনেকেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অলরেডি আমার কাছে পাঁচটি ইনভাইটেশন এসেছে। আগামী তিন মাসের মাঝে আসার জন্য। তবে আমার একটু পরিকল্পনা করে আয়োজন করতে হবে। যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে আবার হয়তো আসবো। এইজন্য নয় যে আমি বিদেশে যাবো, আমি টাকা কামাবো এমন চিন্তা থেকে নয়। যেখানে দেখি যে মানুষ আগ্রহ ভরে ভালো গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছে, সেখানে যাওয়া মানে জীবনটা যেন আবার নতুন করে পাওয়া হয়। প্রশ্ন: আমরা ফেইসবুকে আপনার একটি লেখা দেখেছি, আপনি বলেছেন যে ক্লাসিকাল শিল্প ও শিল্পীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের আরো অনেক কিছু করার আছে। এখানে আপনি কি বিষয়ে বলতে চেয়েছেন? উত্তর: আপনি যে লেখাটির কথা বলছেন ওখানে একটি ইনফরমেশন আছে। ইংল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ে অপেরা শিল্প হারিয়ে যাচ্ছিলো। গায়ক রফিকুল আলম এ বিষয়ে আমাকে বলেছিলেন। ত্রিশ বছর আগে উনি লন্ডনে অপেরা দেখতে গিয়েছিলেন। পাঁচ পাউন্ড দিয়ে টিকেট কিনেছিলেন। যেয়ে দেখতে পেলেন, দেড়শ পারফর্মার কিন্তু অডিয়েন্স ত্রিশ জন। সেই উনি ত্রিশ বছর পর আবার গেলেন কিন্তু ছয় মাসের আগে টিকেট পাননি। সেই টিকেটের দাম আবার দুশো পাউন্ড। এটা কিভাবে হয়েছে? এর কারণ হলো সরকার তাদেরকে প্রটেকশন দিয়েছে। কেন প্রটেকশন দিয়েছে? কারণ এটা তাদের ঐতিহ্য, তাদের সংস্কৃতি। এই জায়গাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু বাংলাদেশ না, বরং পৃথিবীর প্রত্যেকটা জাতির জন্যই খুব ইম্পরটেন্ট। তার যেটা মূল ও নিজস্ব বিষয় সেটাকে ধরে রাখার জন্য তার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সরকারী নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতেই হবে। এখানে আমাদের কিছুটা ব্যর্থতা আছে। অনেক কিছু করার আছে। আমি এটাই বলতে চেয়েছি। প্রশ্ন: ব্যক্তি হিসেবে সুজিত মোস্তফা নামে আপনি নিজেই একজন বিখ্যাত মানুষ। অন্যদিকে আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তির সন্তান ও বিখ্যাত ব্যক্তির স্বামীও। আপনার নিজের এই তিন সুপরিচিত পরিচয়কে একসাথে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? উত্তর: সত্যি কথা হলো, আবু হেনা মোস্তফা কামালের সন্তান হিসেবে আমি সত্যিকারের গর্ব ও আনন্দ অনুভব করি। কারণ উনাকে আমি আদর্শ হিসেবে চোখের সামনে পেয়েছি। উনি যে কেবলমাত্র একজন বিদ্বান ও ভার্সেটাইল মানুষ ছিলেন তা নয়, পাশাপাশি উনি অসম্ভব সৎ ও নীতিবান একজন মানুষ ছিলেন। উনার গাইডেন্স আমার সারাটি জীবনকে প্রভাবিত করেছে। উনি কখনো অর্থকড়ি চাননি। বরং তাঁর জ্ঞান, বিবেক, লেখা দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছে। মানুষকে সম্ভবপর সব সহযোগিতা করতেন তিনি। এটা আমার জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। অন্যদিকে আমার বউ খুব ভালো নাচে। আন্তর্জাতিকভাবে তার ভালো পরিচিতি আছে। আমার নিজেরও কিছু পরিচিতি আছে। এগুলো আসলে অন্য একটি ব্যাপার। একজন মানুষ যখন তার নিজের কাজে কনসেনট্রেট করে তার একটা অবস্থান তৈরি হয়ে যায়। তবে এই অবস্থানটাকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি। আসলে আমরা সবাইই খুব সাধারণ মানুষ। আমি কাওয়ালী গান গাই, আমি খুব সাধারণ মানুষের গান গাই। আমি মানুষের আনন্দ বেদনার কাব্য নিয়ে গল্প করি। এখন আমি যদি মনে করি যে আমি বিরাট স্টার আমার এই আছে সেই আছে, তাহলে আমি মূল জিনিসটা তো ধরতেই পারবো না। তাই যখন আমাকে খুব বড় করে উপস্থাপন করে, তখন আমার খুব বিব্রত লাগে। আমার মনের সত্যি কথাটাই বলছি এখানে। বরং একজন যখন আমাকে ভালোবেসে নিজের মতো করে কথা বলে, বাড়িতে ভাত-মাছ পাকিয়ে একটু খাওয়ায়, একটু আদর করে কাছে টেনে নেয়, একটা ছবি তুলে তখন আমি আনন্দ পাই। তখন আমার মনে হয় বলি, ঐ যে আছেনা মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক। প্রশ্ন: একজন গ্রেট শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠার পথে এই জীবনে আপনার প্রথম পদক্ষেপটি কি ছিলো? উত্তর: প্রথম কথা, আমি কোন গ্রেটনেস এচিভ করতে পারিনি। এটা অনেক বড় একটা টার্ম। আমি কেবল মিউজিকটা পারসু করছি। আমি মিউজিকটা বুঝার চেষ্টা করছি। এটা কতটা বড় বিষয় তা ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। আমাদের উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তী ও ক্লাসিকাল মিউজিকের শিল্পী উস্তাদ আলাউদ্দীন খান বেঁচে ছিলেন একশ ষোল বছর। মৃত্যুর আগে উনি একজনকে দুঃখ করে বলেছিলেন, সঙ্গীতের গভীর সমুদ্রের তীরে কিছু নুড়িপাথর নাড়াচাড়া করলাম। পানিতে পাই রাখতে পারলাম না, ডুব দেয়া তো দূরের কথা। যদি আলাউদ্দীন খান সাহেব এটা বলে থাকেন, তাহলে তো আমরা এখনো সঙ্গীতের হদিস পাইনি। তবে হ্যা, সঙ্গীতের মাঝে খুব ইন্টারেস্টিং ও ফেনোমনাল একটা ব্যাপার আছে। এর মধ্যে গান, কবিতা, গল্প, স্মৃতি, রোমান্স, পাওয়া, না পাওয়া, হারানো, বেদনা এগুলোর বাইরে আরেকটা জিনিস থাকে। সেটা হচ্ছে সার্চিং অফ দ্য সোউল। আমি কে? বা, আমি কী? আপনি যদি একটু চিন্তা করে দেখেন, আমি আপনি আমরা কেউই থাকবো না। তাহলে এই অবস্থানটা কেন? এতো আয়োজন করে, বাড়ি গাড়ি জায়গা জমি করে, অনেক কিছু করে আমরা থাকি। এই যে আমরা আউটিং এর যাচ্ছি, আমরা খাচ্ছি দাচ্ছি গল্প করছি নানান কিছু করছি, এ সব কিছুই জীবনটাকে কেবল একটু বর্ণিল করার জন্য। একটু উপভোগ্য করার জন্য। কিন্তু জীবনের এতো রঙের মাঝেও একটা বিশাল না দেখা রঙ লুকিয়ে থাকে। মানুষকে আমি মনে করি তিনটা ভাগে ভাগ করা যায়। যোগী, ভোগী এবং রোগী। রোগীর শ্রেণী হচ্ছে যারা পুরোপুরি টাকার পেছনে ছুটছে, সম্পদের পেছনে ছুটছে। অথবা নারী, মাদক বা জুয়াখেলার পেছনে। অর্থ্যাৎ যারা জীবনটাকে মনে করছে জীবনের অর্থ হলো এসবই। তারা এগুলো মধ্যে সুখ খুঁজে বেড়ায়। হয়তো কিছু ফিজিকাল আনন্দ আছে, ক্ষমতার আনন্দ আছে, কিছু মানুষের কাছ থেকে আলগা শ্রদ্ধা পাওয়ার আনন্দ আছে। কিন্তু ততটুকুই। আর দ্বিতীয় যেটা ভোগীর শ্রেণী, যারা একটু আনন্দও চায় আবার একটু জীবনটাকে স্পিরিচুয়ালি বুঝবার চেষ্টাও করে। যেমন ধরেন, আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু আমি একটু বুঝার চেষ্টা করি যে জীবনটা কি। সেখানে গান আমার গান আমার একটা বড় হাতিয়ার। আর যারা যোগীর শ্রেণী, তারা অন্যরকম। এডুকেশনের প্রথম ধাপ আমি এটাকে বলি। শিক্ষিত শ্রেণীকে আমি তিনভাগে ভাগ করে দেখি। এডুকেটেড, লার্নেড এবং এনলাইটেন্ড। এই যে এনলাইটেনমেন্ট, এর বাংলা হলো অন্তঃর্জ্ঞান। আপনার যখন অন্তঃর্জ্ঞান আসবে, এই যে বলা হয় অন্তর মম বিকশিত করো, আপনি আসলে আপনার অন্তরকে জানেন না, এই অন্তরকে বুঝবার জন্য মিউজিক হলো একটা বিরাট অস্ত্র, বিরাট হাতিয়ার। যতই অডিয়েন্স থাকুক এবং যে যাই বলুক, গভীর রাতে নিজে বসে যখন সুরটা তুলি, ধুন ধরি, চারিদিকে যদি নৈঃশব্দ থাকে এবং যদি আমি পুরো মনযোগ দিতে পারি তখন যে নিজেকে চেনার সুযোগ হয়, আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনারে, ঐ আনন্দটার কিন্তু কোন তুলনা নেই। ঐ আনন্দটি একজন মিউজিশিয়ানকে ক্রমাগত ইন্সপায়ার করে যায়। প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আমার দাদার দাদা ছিলেন হাসন রাজা। উনাদের মতো শিল্পীরা যে সময়ে যেই কালে ও স্থানে গান গেয়েছেন, যেই আঙ্গিকে উনারা গানে সুর তুলেছেন, আপনি একজন শিল্পী হিসেবে ঐ ঘরানাকে কিভাবে দেখেন? উত্তর: যারা লোককবি, মরমীকবি ও চারণকবি তাদের মর্যাদা অন্যখানে। আমাদের গ্রামবাংলার গল্পটা একটু আলাদা। কারণ ঐদিকে ভাববাদের প্রভাব পড়েছে। আমরা যেহেতু সামগ্রিকভাবে দরিদ্র সমাজ, দরিদ্র মানুষের একটি বড় আশ্রয় হলো ধর্ম। ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবানে নির্ভরতা। আমাদের সব অপ্রাপ্তির পূরণ আমরা খুঁজি তাকে দেখে। আপনি দেখেন, আমাদের উপমহাদেশে ইসলাম কিন্তু বিকশিত হয়েছে সুফী সাধকদের হাত ধরে। অনেক সময়েই কাওয়ালী গানের মাধ্যমে। কারণ উনারা জানতেন যে এই এলাকার মানুষ গান পছন্দ করে, সুর পছন্দ করে। তাই তার মাঝে তারা ধর্মকে সমন্বিত করেছেন। আর হাসন রাজা, লালন বা করিম শাহ উনারা হচ্ছেন অসাধারণ পর্যায়ের মানুষ। আপনি উনাদেরকে সাধারণের কাতারে এনে বুঝতে পারবেন না। এই মানুষগুলো আনপড় হয়েও দর্শনচিন্তার যে পর্যায়ে পৌছেছিলেন সেটা আমরা দুটো পিএইচডি করেও বুঝতে পারি না। উনারা জীবনের গুঢ় কথা ভাবতেন। যেমন ধরেন, হাসনের ঘরবাড়ির কথা। কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের মাঝার। লোকে বলে ঘরবাড়ি ভালা না আমার! কারণ সে তো জানে যে তাকে চলে যেতে হবে। লালনের কথাই ধরুন। ইন ফ্যাক্ট, আপনি দেখবেন লালনের দেহতত্ত্ব, বাউলতত্ত্ব এবং সুফীবাদ ও এমনকি ধর্মের মূলকথাগুলোকে এক জায়গায় চলে আসতে। হাসন লালন উনারা মিউজিকের মাধ্যমে এ বিষয়গুলোকে ইন্টারপ্রেট করেছেন। উনারা হলেন আমাদের পথ চলার জন্য উদাহরণ। প্রশ্ন: এখন একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, অনেকেই নজরুল সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীতকে নতুন ভাবে গাচ্ছেন সুর বদলে ফেলছেন, এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন? উত্তর: পৃথিবী তো বদলাবেই। পৃথিবীর সবকিছু তাই বদলাচ্ছে। আমরা একসময় লুঙ্গি পরে থাকতাম, মাঠে টয়লেট করতে যেতাম। প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে, সভ্যতা বিকশিত হচ্ছে। তাই মানুষ সবসময় পরিবর্তনের পিপাসু। আমরা যদি একটু ডালভাত খেয়ে নেই তাহলে তো পেট ভরেই যায়। কিন্তু একটু সুন্দর প্লেট, একটু পরিস্কার ঝকঝকে গ্লাসে পানি, একটু সাজানো সালাদ এসব কেন খুঁজি? ঐ যে দেখার একটা আনন্দ আছে না, সেটাও কিন্তু একটা তীব্র আনন্দ সৃষ্টি করে। যখন একই গান আমি শুনছি, একই এমবিয়েন্স-এনভায়রোনমেন্ট-মিউজিকে থাকছি, তখন মনে হচ্ছে এই গানের অর্থটা যদি একটা অন্য মোড়কে আসতো তবে হয়তো ভালো হতো। যত দামী পোষাকই হোক, আপনি কিন্তু একই পোষাক রোজ পরছেন না, বরং বদলাচ্ছেন। টু ব্রিং ইন ভেরিয়েশন। সেইটা যদি আমি গানের মধ্যে আনতে পারি, সমস্যা কোথায়? তবে আমার যেটা খেয়াল রাখতেই হবে, আমি যে ইনস্ট্রুমেন্টটা আনছি বা যে মিউজিকটা আনছি সেটা আমার গানের কবিতাকে যেন নষ্ট না করে। গানের ভাবটাকে যেন নষ্ট না করে। গানের তিনটা কবিতা থাকে। দৃশ্যকবিতা, অন্তর্গত কবিতা, তৃতীয় কবিতা। তৃতীয় কবিতাটা হলো কেবলমাত্র পারফর্মাররাই অনুভব করতে পারেন। এটা আমি সবসময় বলি। যিনি গান লিখেছেন বা সুর করেছেন, তিনি তার ভাবনা থেকে করেছেন। কিন্তু আমি ঐ ভাবনার মধ্যে আটকে থাকতে চাইনা। আমি যখন গাইছি, তখন তো আমি একজন আলাদা ব্যক্তি। আমার ভাবনাকে আমি ওখানে সংযুক্ত করতে চাই। যদি ভাবনাকে সংযুক্ত করতে চাই, তাহলে আমার অবশ্যই উপাদান লাগবে। সারা পৃথিবীতে এতো চমৎকার সব ইনস্ট্রুমেন্টস আছে আমাকে শুধু এসবের পরিমিত ব্যবহার জানতে হবে। যেন আমার জিনিসটাকে আমি নষ্ট না করে বরং আরো সুন্দর করে তুলতে পারি। যেমন ধরেন একজন গ্রেট সিঙ্গার। এখানে আমি নাম উল্লেখ করতে চাইছি না। কি অসাধারণ সব গান গেয়েছিলেন! কিন্তু ওনার প্রত্যেকটা গান বত্রিশ বছর আগে গাওয়া। উনি কিন্তু এখনো পারফর্ম করছেন, এখনো সুরেলা, এখনো তার চাহিদা আছে। উনি কোন নতুন গান করছেন না। উনার কোন গান হিট হচ্ছেনা। কেন? একজন আর্টিস্ট সুরে গাইবে, তালে গাইবে এমনটা নয়। তাকে বিকশিত হতে হবে। বিবর্তিত হতে হবে। সময়কে ধারণ করতে হয়। ঐটা উনার বন্ধ হয়ে গেছে। এটাকে আমরা বলি স্যাচুরেশন পয়েন্ট। এটা কবিরও হয়। রাইটার্স ব্লক হয়। যখন আপনি বলছেন যে আরো শুনতে মন চাইছে, তার মানে হচ্ছে চাহিদাটা আমি সৃষ্টি করতে পারলাম। এটা আমার একটা সফলতা। শিল্পকে বেঁচে থাকতে হলে তাই নতুনকে স্বাগত জানাতে হবেই। প্রশ্ন: পাঠকদের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে কিছু বলুন। উত্তর: আমি এই আলাপচারিতায় অনেক বড় বড় কথা বলে ফেলেছি, সেগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। এতো কথা বলার অধিকার আমার হয়ে উঠেনি। আমি খুবই ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু এটাও একটা জিনিস, অনেক সময় অনেক কথা বলে ফেলি। একটা সময় আমি ভাবতাম আমি বোধহয় কিছুই বুঝিনা বা কিছুই জানিনা। সবাই অনেক কথা বলছে, সেগুলো শুনছি। শুনতে শুনতে দেখেছি, যারা অনেক ভাব ধরে থাকে তারা অনেকেই অনেক কথা বলে যা বলার অধিকার আসলে তাদের নেই। তাই আমিও একটু একটু করে সাহস করে কথাগুলো বলা শুরু করেছি। কি হবে? আমাকে কি কেউ মেরে ফেলবে? তাছাড়া মরতে তো হবেই। তাই আমার বোধের ও চিন্তার জায়গাগুলো এখন বলি। হতে পারি আমার কথাগুলো ভুল। এমন না যে সবসময় আমি শতভাগ ঠিক কথা বলছি। কিন্তু আমি তো একটা প্রসেসের মধ্যে আছি। তাই পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমার যে কথা তা হলো, হিপহপ, রক বা আন্তর্জাতিক গানের পেছনে ছোটার কোন দরকার নাই। কারণ আমাদের নিজস্ব যে গান আছে তার মূল সম্পদ হলো মেলোডি, ভাব, রস, রুপ, চিত্রকল্প, গল্প, কল্পনা, রোমান্টিসিজম এসব এতোই সমৃদ্ধ যে আমাদের কারো কাছ থেকে ধার নেয়ার দরকার নাই। আমার নতুন ছেলেমেয়েদেরকে সবসময় আমি আন্ততর্জাতিকতাবাদ নিয়ে একটা কথা বুঝাই। অনেকে বলে, আপনারা শুধু নজরুল, রবীন্দ্র, দেশের গান এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমরা তো আন্তর্জাতিক হিপহপ রক শুনি। আমি ওদেরকে বলি, তোমরা আন্তর্জাতিকতাবাদ জিনিসটাকে বুঝার চেষ্টা করো। হিপহপ রক এসব হলো ওদের কালচার। ওরা ওদের জিনিসগুলোকে পপুলার করে তোমার কাছে পৌছে দিতে পেরেছে। ইন্টারন্যাশনালি ওদের মেরিট আছে, তারা তা অর্জন করেছে। তোমার কাজ হচ্ছে তোমার যা আছে তাকেই আন্তর্জাতিক বানিয়ে তোলা। তোমার সংস্কৃতিকে ওদের কাছে নিয়ে যাও। একে ওদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলো। তখনই আমি বলবো যে তুমি আন্তর্জাতিকতাবাদ বুঝেছো। এই জায়গাটাতে আমাদের একটা হীনমন্যতা আছে। আমাদের নিজেদেরকে আমরা চিনিনাই, আমরা পরের ধনে পোদ্দারী করতে চাই অনেক সময়। এ বিষয়গুলো আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। সূত্র : প্রভাতফেরী এম এন / ০৬ মে



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2WbNzpn
May 06, 2020 at 07:49AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top