ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর- মূলধারার নৃত্যের প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী বললে যার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি মুনমুন আহমেদ। নামের সাথে যার একজোড়া চাঁদ আজ তার ৫০তম জন্মদিন। ১৯৬৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার আজিমপুরে মুনমুন আহমেদের জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম রফি আহমেদ বিদ্যুৎ, মা সালেহা বেগম। অসাধারণ নান্দনিক চিন্তাভাবনা ও সৌন্দর্য্যরে অধিকারী মুনমুন আহমেদ তার নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি একাধারে দক্ষ পারফর্মার, কোরিওগ্রাফার, নৃত্য নির্দেশক এবং শিক্ষক। অবশ্য মাঝেমধ্যে তাকে অভিনয় করতেও দেখা যায়। মুনমুন আহমেদ বাংলা ভাষার খ্যাতিমান গীতিকার, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের পুত্রবধু; বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী সুজিত মোস্তফার স্ত্রী। তাদের একমাত্র কন্যা অপরাজিতা মোস্তফা। সেও দক্ষ কত্থকশিল্পী। নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের শিল্পী-জীবনের সূচনা হয়েছিল গান শেখার মাধ্যমে। কৈশোরে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিতেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীতগুরু ওস্তাদ আখতার সাদমানীর কাছে। কিন্তু কৈশোরের চঞ্চল স্বভাব, মন বসত না হারমোনিয়ামে। তবু বাবা-মায়ের চেষ্টার কমতি ছিল না। একদিন সংগীতশিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ তাকে বলেন গান গাইতে গিয়ে এত ছটফট কর কেন? গান ভালো না লাগলে ওস্তাদ রেখে নাচ শিখলেই পার। এ কথা শোনার পরই তার জীবনের বাক বদলে যায়। তিনি নাচ শিখতে শুরু করেন। নাচে তার হাতেখড়ি হয় ওস্তাদ আজহার আলী সাহেবের কাছে। তার অধীনে কিছুদিন তালিম নেওয়ার পর চলে আসেন নৃত্যগুরু হাবিবুল চৌধুরী ও সালেহা চৌধুরীর অধীনে। তাদের কাছে নাচের করণ-কৌশলগুলো দ্রুত শিখে নিয়েছিলেন মুনমুন। এক পর্যায়ে মনোনিবেশ করেন নিবিড়ভাবে নৃত্যচর্চায় এবং শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে (১৯৭৩ এবং ১৯৭৫) পুরস্কার লাভ করেন বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে। এরপর নাচ শেখার আগ্রহ বেড়ে যায় তার। তখন পদ্ধতিগত কত্থক নাচের তালিম নেন বিশিষ্ট নৃত্যগুরু সৈয়দ আবুল কালামের কাছে। তার অধীনে মুনমুন একজন চৌকস পারফর্মার হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন। ঢাকার বিভিন্ন মঞ্চে তার একক নৃত্য প্রদর্শনী প্রশংসা কুড়ায়। মুনমুন আহমেদ মিরপুর বাংলা স্কুল থেকে এসএসসি, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসির পর বিএসসি কোর্সে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)। তবে স্নাতক শেষ করতে পারেননি। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে নাচ শিখতে দিল্লি চলে যান তিনি। ভারতের কত্থক কেন্দ্র থেকে ১৯৯০ সালে তিনি উচ্চাঙ্গ নৃত্যে (কত্থক) সম্মান সহ ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন মুনমুন আহমেদ। ১৯৯২ সালে তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চাঙ্গ নৃত্যে সম্মানোত্তর পোস্ট ডিপ্লোমা ডিগ্রী ও ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে ফেলোশিপ লাভ করেন। দিল্লিতে তার গুরু ছিলেন মহান কত্থক নৃত্যগুরু পন্ডিত বিরজু মহারাজ, পন্ডিত রাজকুমার শর্মা ও পন্ডিত রামমোহন মহারাজ। এছাড়া আমেরিকান ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল ওয়ার্কশপ, ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল ওয়ার্কশপে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। তার সাধনাকে ছড়িয়ে দিতে ১৯৮০ সালে নিক্কন ললিতকলা একাডেমি নামে একটি নাচের স্কুল চালু করেছিলেন যা ১৯৮৭ পর্যন্ত চালু ছিল। ১৯৯৩ সালে পুনরায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রেওয়াজ পারফরমার্স স্কুল। এখানে অনেক শিক্ষার্থী বিশুদ্ধ কত্থক নাচের তালিম নিচ্ছে মুনমুন আহমেদের অধীনে। একাধিক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, কেনিয়া, জাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইরাক, কাতার, লিবিয়া, চায়নাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুনমুন আহমেদ নৃত্য পরিবেশন করেছেন। এস এ গেমেসর উদ্বোধনী দিনে নাচোলের রানী নৃত্যনাট্যে নৃত্য পরিচালনা করেছেন তিনি। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন ইলা মিত্রের চরিত্রেও। তিনি বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সদস্য। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ৬ জন প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নৃত্যধারার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এই সংস্থা বাংলাদেশের নৃত্য ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করে থাকে। মুনমুন আহমেদ দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে আছে- ১৯৮০ সালে শিশু একাডেমী আয়োজিত উচ্চাঙ্গ নৃত্যে জাতীয় পুরস্কার, ১৯৮১ একই প্রতিষ্ঠান আয়োজিত উচ্চাঙ্গ নৃত্য ও সাধারণ নৃত্যে জাতীয় পুরস্কার ও ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত কূল নাই কিনার নাই গীতি নৃত্যনাট্যের দলীয় শিল্পী হিসেবে এন.এইচ.কে. জাপান পুরস্কার। এছাড়াও ২০০০ সালে ইউনেস্কো সাংস্কৃতিক পুরস্কার, ২০০১ ও ২০০৩ সালে একতা পুরস্কার, ২০০৩ টেলিভিশন দর্শকশ্রোতা পুরস্কারসহ একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় তাকে নিয়ে অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মুনমুন আহমেদ অভিনয় করেছেন হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত আমার আছে জল ও ঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্রে। ম্যাঙ্গোলী-চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ে-এর সিজন থ্রির বিচারক হিসেবেও দেখা গেছে তাকে। এদিকে জীবনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ধানমণ্ডির ছায়ানট মিলনায়তনে একটি কত্থক নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন মুনমুন আহমেদ। নাম ফিফটি-টোয়েন্টি কত্থক যুগলবন্দি, যাতে মুনমুন আহমেদের সঙ্গে নাচবেন তার ২০ বছরের মেয়ে অপরাজিতা মোস্তাফা এবং ২০-এর কোঠায় থাকা ছাত্রছাত্রীরা। সবার জন্য উন্মুক্ত এই অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য মুনমুন আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, নিজের ঘনিষ্ঠজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার আয়োজন সাজানো হয়েছে ঠুমরি, তারানা, গুরুবন্দনা, যুগলবন্দি ও টেকনিক্যাল পার্ট দিয়ে। আর/১৭:১৪/২৭ ডিসেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2izJncc
December 27, 2016 at 11:09PM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top