ঢাকা::
বর্তমান সরকার শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্যকে পদদলিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, একথা আজ স্বীকার করতে হবে যে- আত্মতুষ্টির কারণে পাসের হার বাড়িয়ে আমাদের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঘটেছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আগামী দিনে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে, আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।
আজ শনিবার বিকেলে শিক্ষা বিষয়ক দলের এক সেমিনারে তিনি একথা বলেন।
শিক্ষার প্রসারে তার দলের অবস্থান তুলে ধরে সদ্যঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’ পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে জিডিপির শতকরা পাঁচ ভাগ ব্যয় করে দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ ও অন্যান্য শিক্ষা সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা বলেন বেগম জিয়া।
তিনি বলেন, আমরা এমন ব্যাবস্থা গড়ে তুলব যাতে শিক্ষা শুধু ডিগ্রি অর্জনের হাতিয়ার হবে না, হবে জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার হাতিয়ার। সর্বোপরি শিক্ষা অর্জনের সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জেন্ডার ও অর্থনৈতিক বাধাসমূহ দূর করা হবে।
তিনি বলেন, সুশাসন, আইনের শাসন আজ নেই বললেই চলে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ক্ষমতাসীন সরকার সব বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা দেশে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনব, প্রতিষ্ঠা করব মানুষের অধিকার। আমরা জানি এ লড়াই কঠিন লড়াই। কিন্তু যে জাতি লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে তাদের কাছে এ লড়াই কোনো কঠিন লড়াই নয়।
রাজধানীর ইস্কাটনে লেডিস ক্লাবে বিএনপির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই জাতীয় সেমিনার হয়।
সমাপনী পর্বে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম ও হেলেন জেরিন খানের পরিচালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
এসময় শিক্ষার দর্শন শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ।
এর আগে সকালে বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলামের সভাপতিত্বে এই সেমিনারের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ।
সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই সেমিনারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: সিরাজুল ইসলাম ও শাহ শামীম আহমেদ।
শিক্ষায় বিভিন্ন ধারা শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।
উচ্চ ও প্রাগ্রসর শিক্ষা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাবির সাবেক প্রোভিসি অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো: সাব্বির মোস্তফা ও শাবিপ্রবির অধ্যাপক ড. মো: ইকবাল।
সমাপনী অধিবেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আখতার হোসেন খান দিনব্যাপী সেমিনারের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। সবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সহ শিক্ষা সম্পাদক হেলেন জেরিন খান।
পরে প্রবন্ধকারদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধান অতিথি খালেদা জিয়া।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে নুরুল আমিন, ড. খলিলুর রহমান, লুৎফর রহমান খান, তাজমেরী এস এ ইসলাম, ড. জাহিদুল ইসলাম, সুকোমল বড়ুয়া, ড. আবদুল লতিফ মাসুম, ঢাবির ড. মামুন আহমেদ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এমতাজ হোসেন, বিএনপির সহ প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, ড. মো: আল মোজাদ্দেদী আলফেছানী, মো: নূরুল আমিন, মো: সাইফুল্লাহ, ইসরাফিল প্রমাণিক রতন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান, খসরুল আলম, নজরুল ইসলাম, নাজমুস সালাত, মোহাম্মদ ইকবাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, ড. মো: শামছুল আলম সেলিম, ড. মো: শরিফ উদ্দিন, এম এনামুল্লাহ (পারভেজ) সহ ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনাসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক-শিক্ষাবিদরা অংশ নেন।
এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা সেলিমা রহমান, আবদুল মান্নান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শামা ওবায়েদ, ফরিদা মনি শহীদুল্লাহ, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আন্দালিব রহমান পার্থ, টিআইএম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, মোস্তফা জামাল হায়দার, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, ড. রেদোয়ান আহমেদ, শফিউল আলম প্রধান, ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, খোন্দকার লুৎফর রহমান, এম এম আমিনুর রহমান, সৈয়দ মাহবুব হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্বেও সেমিনারে যোগদানের জন্য অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রমের সমালোচনা করে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, শিক্ষা মানুষকে গণতন্ত্রের প্রতি, ভিন্নমতের প্রতি, ভিন্নমত প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার শিক্ষার এই মৌলিক লক্ষ্যকে পদদলিত করেছে। বিরোধীমতের লোকজনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। মোদ্দাকথা, শিক্ষার সব উদ্দেশ্য আজ ভুলুণ্ঠিত। সুশাসন, আইনের শাসন আজ নেই বললেই চলে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ক্ষমতাসীন সরকার সব বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে।
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জীবনভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলার মতো শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। বর্তমানে একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রতিটি ব্যবস্থার লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতার সাথে সমাজের বিরাজমান যে শ্রেণি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে তা সম্পর্কিত। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি সমাজে যেখানে মাদরাসা শিক্ষার জন্য নিজেই অর্থের সংস্থান করে, সমাজের সুবিধাভোগীরা সেখানে ভিন্ন ধরনের শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় করে। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে প্রচলিত সবধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে হবে। কারণ সব শিক্ষার মধ্যেই ইহলোকিক ও পরলৌকিক জীবন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা আছে।
বেগম জিয়া বলেন, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিএনপির নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে। যেভাবে দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে তার সাথে তাল মেলাতে না পারলে ভবিষ্যতে আমাদের চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে। এ কারণেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জীবনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের মানুষকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলবে।
এসময় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, জনসংখ্যাকে যদি জনসম্পদের পরিণত করতে হলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ও সংগঠনের মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত করলে এটা একটা পাওয়ার হবে, এটা একটা ইকনমিক প্রডাক্ট হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই চিন্তাকে মাথায় রেখে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়েছিলো। আমরা শিক্ষাকমিশনও গঠন করেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
খালেদা জিয়া বলেন, জনইচ্ছার প্রতিফলনে আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি শিক্ষাব্যবস্থাকে জনকল্যাণমুখী করবে। শুধু ডিগ্রি প্রাপ্তির মোহ থেকে দেশের তরুণদেকে মুক্ত করতে হবে। সামর্থ, মেধা, ও চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিশ্চিত ব্যবস্থা আমরা করতে চাই। পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা, শত শত ধরনের ট্রেড ও পেশার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি মানবসম্পদকে বিকশিত করতে পারে। এ ব্যাপারে ‘ভিশন ২০৩০’ চিন্তা-ভাবনাও তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের জনসংখ্যা বয়সভিত্তিক কাঠামো যেভাবে বদলে যাচ্ছে তা মোকাবিলায় মূল কৌশল হবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা এবং আকর্ষণীয় চাকরির-বাজার সৃষ্টি করা। শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের নিশ্চিত ব্যবস্থা আমরা করতে চাই। বিশেষ করে বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারী ও পুরুষ যুবকদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রয়োজনীয় সেতুবন্ধন রচনা করা। অগ্রসর জ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি ও শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। মানবসম্পদ উন্নয়নের ব্যবহারিক জ্ঞান, তাত্ত্বিক জ্ঞান, প্রায়োগিক ও তাত্ত্বিক গবেষণাসহ সব ধরণের জ্ঞান চর্চার মধ্যে ভারসাম্য অর্জন করতে পারলে পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব।
সবশেষে সারাদিন ‘পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা’ শ্লোগানের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কে সেমিনারের আয়োজক ও আলোচকদের আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, আশা করি ভবিষ্যতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ও মানোন্নয়নে এসব বক্তব্য ও সুপারিশ সহায়ক হবে।
from ঢাকা – দ্যা গ্লোবাল নিউজ ২৪ http://ift.tt/2pvCjVW
May 13, 2017 at 10:57PM
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন