আবুধাবি, ০২ সেপ্টেম্বর- পাথুরে পাহাড়ি জনপদ ফুজেইরাহ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষুদ্রতম এ অঙ্গরাজ্যটির অবস্থান হাজার পর্বতমালার পাদদেশে। ওমান সীমান্তের কাছাকাছি। গালফ অব ওমানের তীর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কর্নিশ ধরে খানিক এগোলে খোরফাক্কান ফ্রি জোন, বিদিয়া হয়ে পড়বে ফুজেইরাহর শেষ সীমান্তের আল জেদনা। এখানে দেখা পেলাম চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার বাইন্যার হাট এলাকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সাথে। ছোটখাটো ওয়ার্কশপ এর মালিক। জানালেন- সানাইয়াতে (মানে শিল্প এলাকায়) কয়েকশ বাংলাদেশি শ্রমজীবী ৭/৮ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না, কোম্পানির কাজ নেই। আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিসা ট্রান্সফারের সুযোগ থাকলে তারা মানবেতর বেঁচে থাকা থেকে মুক্তি পেতেন। সিলেটের মৌলভীবাজারের জুডি থানার গোয়ালবাড়ী গ্রামের তরুণ রেমিটেন্স সৈনিক বেলাল আহমদ। ফুজেইরাহর গেরাইয়াহতে তার একটি ওয়েল্ডিং শপ আছে। তার ব্যবসায় কমপক্ষে ৫ জন লোকের প্রয়োজন। বেলাল জানালেন, তিন বছর আগে বহু আশা করে লাইসেন্স খুলেছিলেন বাংলাদেশের বন্ধ ভিসা খুললে দেশ থেকে লোক এনে পুরোদমে ব্যবসা শুরু করবেন। তার ইচ্ছেগুলো অধরাই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই কাজ একা করা যায় না, বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করাতে যেয়ে ধরা পড়লে ১১/১২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড গুণতে হবে ভয়ে তাও করতে পারছিনা না। লাইসেন্স ফি, দোকান ভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটি বিল, অনলাইন রেজিস্ট্রেশানের জামানতের টাকা জোগাড় করতে আয়ের পুরোটা যাবার পরও ধার-দেনা হচ্ছে। ৭ বছর বাড়ি যেতে পারেননি অর্থ সঙ্কটের কারণে। পড়েছি বড়ই বিপাকে। আবুধাবির উপকণ্ঠের আল বাহিয়ার একটি সাবিয়ায় (আরব পল্লী) দেখা হল চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বড়বিবির হাট নিবাসী মোহাম্মদ হোসেনের সাথে। স্থানীয় আরব নাগরিকের একটি ভিলার ইলেকট্রিক ও প্লাম্বিং এর কাজ করেন তিনি। তার প্রাপ্য টাকার জন্য আরও অনেক দিনের মত সেদিনও আরবের ভিলার বাইরে পাহারায় ছিলেন। একটি জেনারেল কন্ট্রাক্টিং কোম্পানির মালিক হোসেন জানালেন, তার কমপক্ষে অর্ধ লক্ষ দিরহাম স্থানীয় আরবদের কাছে আটকে আছে, আদৌ পাবেন কি না জানেন না। অন্যদিকে কাজ চালানোর জন্য তার কমপক্ষে ৮/১০জন কর্মচারী দরকার, আছে মাত্র ৩ জন। উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তান থেকে লোক আনেন, কিন্তু কেউই দু/চার মাসের বেশি থাকে না। হোসেন বললেন,শিগগিরই ভিসা না খুললে আমাদের এদেশে থাকার আর রাস্তা খোলা থাকবে না। আবুধাবীর গ্রিন সিটি আল আইন এর মাজিয়াদ লেবার ক্যাম্পে অবস্থানরত এম বি এম ডাল্লাহ কোম্পানির ৭শ থেকে ৮শ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমজীবীর সম্প্রতি কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। এরা ছিলেন পরিচ্ছন্ন কর্মী। অপরাধ- কোম্পানির কাজের কন্ট্রাক্ট নবায়ন হয়নি আর তার সরাসরি শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি এই শ্রমজীবীর দল। এখানে কর্মরত ভারত নেপাল, পাকিস্তানের কর্মীরা ভিসা ট্রান্সফার করে নতুন কন্ট্রাক্ট লাভকারী কোম্পানিতে গেলেও বাংলাদেশিরা যেতে পারেননি এদেশে তাদের ভিসা ট্রান্সফার বন্ধ থাকায়। ভিসা বন্ধের বলি হয়েছেন আবুধাবির ওয়েস্টার্ন রিজিয়নের বিদা যায়েদ ও লিওয়ার সাড়ে তিনশ বাংলাদেশি শ্রমজীবী। এরা আবুধাবি ওয়েস্টার্ন রিজিয়ন মিনিসিপ্যালিটিতে কর্মরত আল দাফরা ইরিগেশান কোম্পানির কর্মচারী। নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধন ও গার্ডেন পরিচর্যার কাজ করেন এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা। হালকা ও ভারী মেশিন অপারেটর, ট্র্যাক্টর চালক, ইরিগেশান কর্মী, গার্ডেনারসহ স্ব স্ব পেশায় এদের ৯০ শতাংশই দক্ষ কর্মী। গত ৩১শে মার্চ মিনিসিপ্যালিটির সাথে তাদের কোম্পানির কার্যচুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১ এপ্রিল থেকে তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন। কোম্পানিতে কর্মরত ভারতীয়, পাকিস্তানি, মিশরীয়, নেপালি ও সুদানি শ্রমজীবীরা মিনিসিপ্যালিটির নতুন কার্যাদেশ প্রাপ্ত কোম্পানি ওয়েস্টার্ন বিচে তাদের ভিসা ট্রান্সফার করলেও আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিসা ট্রান্সফার বন্ধের কারণে বাংলাদেশিরা তা করতে পারছেন না। এদের মধ্যে অনেকেই মরীয়া হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ম্যানপাওয়ার কোম্পানির অধীনে স্বল্প বেতনে কাজ করছেন। এমনই একজন সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার দেলোয়ার হোসেন নিজেকে পরিচয় দেন একজন মাকিনা অপারেটর (ভারী মেশিন অপারেটর) হিসেবে। তিনি বলেন, খফালঅ দুর্ভোগ আছে, খিতা খরতাম বাই? দেশর মাটি ত বুলি গেছি। দেখি আল্লাহ নসীবঅ খি রাখছে? এর পরই আমিরাতে বসবাসরত লাখো রেমিটেন্স সৈনিকের মত তার সেই প্রশ্ন,ভিসার কোনও খবর আছে? যে প্রশ্নের কোনও উত্তর একজন সংবাদ কর্মীর কাছেও নেই। গত ১২ আগস্ট ছিলো সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশীদের ভিসা বছর পূর্ণ হওয়ার দিন। দেশটির শ্রমবাজারে সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছিলো বাংলাদেশিদের অবস্থান। ২০১২ সালের ১২ অগাস্ট থেকে দেশটিতে বাংলাদেশের সব ধরণের নতুন ভিসা ইস্যু এবং আভ্যন্তরীণ ভিসা রিলিজ ট্রান্সফার বন্ধ থাকায় যা এখন তিন কিংবা চারে এসে নেমেছে। প্রসঙ্গত ২০১২ সাল থেকে আমিরাত সরকার গৃহকর্মী ও ফ্রি জোনের কিছু ভিসা ছাড়া বাংলাদেশিদের সব রকমের ভিসা বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসেবে তারা দেখায়- আমিরাতের শ্রমবাজারে চাহিদার অতিরিক্ত বাংলাদেশি অভিবাসীর অনুপ্রবেশ এবং ভিসা জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতার সাথে অত্যাধিক হারে বাংলাদেশিদের জড়িয়ে পড়া। দীর্ঘ ৫ বছর ভিসা বন্ধ থাকার কারণে তুমুল প্রতিযোগিতাময় এ শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের স্থান দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ভারত, ফিলিপাইন, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোর অভিবাসীরা। গত ৫ বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ থাকার কারণে প্রয়োজনীয় জনশক্তির অভাবে ক্ষুদ্র পুঁজির অনেক বাংলাদেশির বিনিয়োগ মাঠে মারা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অনেকেই আবার লোকসান গুনতে গুনতে এক পর্যায়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে অদক্ষ শ্রমিক হয়ে এদেশের শ্রমবাজারে এসে দক্ষতা অর্জন করলেও স্পন্সর পরিবর্তনের কোনও উপায় না থাকায় বাংলাদেশি প্রান্তিক শ্রমিকদের অনেকেই ন্যুনতম মজুরিতে এই দুর্মূল্যের বাজারে মানবেতর প্রবাস কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো জনবল সঙ্কটের কারণে বাধ্য হয়ে ভিনদেশিদের নিয়োগ দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বিপাকে পড়েছেন। কারণ দক্ষতা ও শ্রম নিষ্ঠার দিক থেকে বাংলাদেশিদের চাহিদা যেমন দেশি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে, তেমনি আছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানেও। অনেকের আশঙ্কা, দক্ষ ভিসা-ডিপ্লোমেসির অনুপস্থিতির কারণে আমিরাতের মত একটি তৈরি শ্রমবাজার হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। ভিসা বন্ধ হওয়ার মূল কারণ- অপরাধপ্রবণতায় জড়িত থাকার দুর্নাম এরইমধ্যে বাংলাদেশিরা একেবারেই কাটিয়ে উঠেছেন। আর একটি সুবিধাজনক অবস্থানে বাংলাদেশ আছে এদিক থেকে যে সৌদি নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস বিরোধী জোটে দেশটি রয়েছে। আমিরাতে একবার পাকিস্তানিদের ভিসা বন্ধ হওয়ার পর শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে এক সপ্তাহের কম সময়ে তা খুলে দেয়া হয়েছিল। আর পাঁচ বছরে ভিসা চালু তো দূরে থাক বরং বাংলাদেশিদের জন্য ইনভেস্টর ভিসার ব্যাপারেও আরোপিত হয়েছে বাড়তি কড়াকড়ি। প্রায় ৫ বছর ধরে ভিসা সঙ্কটে নাকাল ৮/৯ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি চলতি বছর ১৫ হতে ২১ মে আমিরাত সফর করেন। তার সফরের মূল এজেন্ডা ছিলো ভিসা। তিনি আমিরাতের ফেডারেল গভর্নমেন্টের মানব সম্পদ ও আমিরাতিকরণ মন্ত্রী সাকর গোবাশ সাঈদ গোবাশ এর সাথে বৈঠক করে বলেছিলেন, আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশিদের ভিসা পরিবর্তন, মালিকানা পরিবর্তনসহ অন্যান্য ভিসা সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি, তারা এতে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে অচিরেই তা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এ আশার বাণী সময় যেতেই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমিরাত সফরের পর ভিসা খোলার একটা জোরালো সম্ভাবনা দেখা গেলেও তা কিছু দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তি ছাড়া তেমন কার্যকর সাফল্য আনেনি। ভিসা বন্ধের পাঁচ বছর পর দ্বিপক্ষীয় আলাপ আলোচনা যেখানে কোনও সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। ফলে আমিরাত প্রবাসীরা একটি মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় দেশের সহযোগিতায় থার্ড পার্টি ডিপলোমেসির মাধ্যমে এ সঙ্কট নিরসনে শক্তিশালী উদ্যোগ চেয়েছেন। আর/১২:১৪/০২ সেপ্টেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2wqkB83
September 02, 2017 at 06:30AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন