মেদিনীপুর, ০৮ ডিসেম্বর- যদি বেশি দূর পড়াশোনা না করেন তাহলে পকেটে টাকা রাখুন। সহজেই সার্টিফিকেট বানিয়ে নিতে পারবেন মানে ডিগ্রি কিনে রাখতে পারবেন। তাহলে চাকরির রাস্তাও বাধা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শুধু নয় আপনি যা সার্টিফিকেট চাইবেন তাই পাবেন। পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে শুরু হয়েছে এমন চক্র। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক হলে ১০১৫হাজার টাকা, গ্র্যাজুয়েট হতে চাইলে গুনতে হবে ২০২৫ হাজার টাকা। আর মাস্টার ডিগ্রি কিংবা পিএইচডি, এমফিল কিংবা এলএলবি সার্টিফিকেট নিয়ে আপনি ওকালতিও করতে পারেন। মানে ট্যাঁকের কড়ি খসালে আপনি যা চাইবেন সেই ডিগ্রি পেয়ে যাবেন বাড়িতে বসেই। পরীক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনার হয়ে অন্যজন পরীক্ষা দিয়ে দেবে। তার জন্যে শুধু খরচটা আপনাকে দিতে হবে। ব্যস, তাহলেই সার্টিফিকেট বাড়িতে চলে আসবে। এরকম সার্টিফিকেট কিনে কতজনই না চাকরি করছেন। শুধু ডিগ্রি চাই বললেই হল। ভুয়ো ডিগ্রির গাছ-পাথর কোথায় পাওয়া যায় এমন সার্টিফিকেট? কেন আপনার পাড়ায় কিংবা শহরে কোথাও না কোথাও বড়বড় সাইনবোর্ড লাগানো করেসপন্ডেস কলেজ বা ডিস্টেন্স এডুকেশন সেন্টারের বোর্ড লাগানো ডিগ্রি বিক্রির দোকানে গেলেই পাবেন। তবে সাবধান, টাকা মার যাওয়ার ভয়ও আছে। এমন কলেজের সার্টিফিকেট হতে হবে যা ইউজিসির অনুমোদিত। কারণ ইউজিসি ইতিমধ্যে ২১টি কলেজকে ব্ল্যাক লিস্টেট করেছে। তাই সার্টিফিকেট একটু বুঝে কেনাই ভাল। এত গেল ডিগ্রি কেনার বিষয়। এবার আসা যাক ম্যানেজমেন্ট কলেজ কিংবা নার্সিং ট্রেনিং কলেজের নামে কীভাবে ঠকানো হচ্ছে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের। অর্থাৎ ম্যানেজমেন্ট কলেজের পাতা ফাঁদে পড়ে কীভাবে অথৈ জলে পড়ছেন ছাত্রছাত্রীরা আর সর্বশান্ত হচ্ছেন অভিভাবকেরা। কথা বেশি কাজ কম পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় দিঘা থেকে হলদিয়া, কাঁথি থেকে কোলাঘাট, এগরা থেকে খেজুরিতে রাস্তার পাশে ঝাঁ চকচকে ভবন। যার জেল্লা ফাইভস্টার হোটেলকেও হার মানায়। বিশালাকার বাড়ির মতো খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন। এমনভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ওই কলেজে পড়লেই যেন চাকরি হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞাপনে প্রলুদ্ধ হয়ে অনেকেই পৌঁছে যান সেই সমস্ত ম্যানেজমেন্ট বা নার্সিং ট্রেনিং কলেজে। আপনি কলেজে গেলেই ডিরেক্টর কিংবা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কিন্তু পাবেন না। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসেপশানে থাকা সুন্দরী কর্মীরা আপনাকে সমস্তরকম সহযোগিতা করবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করানোর পরে শেষমেশ পৌঁছে দেবেন সেই ব্যক্তির কাছে যিনি কথা বলায় পটু। উনি এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনার ছেলে কিংবা মেয়ের চাকরি হাতের মুঠোয়। কমপক্ষে ২৩লক্ষ টাকা তিন বছরের কোর্সের গল্প দেবেন। বলবেন কিস্তিতে টাকা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ১০০ শতাংশ প্লেসমেন্টের কথা গলা হাঁকিয়ে বললেও পড়া শেষে চাকরিপ্রার্থীকে কত টাকা মাইনের চাকরি দেওয়া হবে কিন্তু কোনওভাবেই উল্লেখ থাকে না। তিন বছর হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার পর হোটেলে কাজ করতে পাঠানো হবে। সেখানে বেতন পাবেন ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। এর থেকে বেশি বেতন আপনার ছেলে বা মেয়ে পাবেই না। আপনি যদি হোটেল ম্যানেজম্যান্ট না পড়েও হোটেলে কাজ করতে যান সেক্ষেত্রেও বেতন ঠিক একই পাবেন। আসলে যারা হোটেল ম্যানেজমেন্ট খুলে লোক ঠকানোর ফন্দি এঁটেছেন তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি। কীভাবে চলে ছক? চাকরির গাজর আসলে ওরা দেশের বেশ কিছু হোটেলে কর্মী পাঠানোর ঠিকা নিয়ে রেখেছেন। সেইমতো বছরে কর্মী পাঠিয়ে থাকেন। আর তার বিনিময়ে মোটা কমিশন পান। তারপর আপনার বাড়ির ছেলেকে পড়াশুনোর খরচ বাবদ পেয়ে যান ২৩লক্ষ টাকা। তাহলে ভেবেই দেখুন আপনি হলেন সর্বশান্ত। জমি বাড়ি বিক্রি করে ছেলেমেয়েকে পড়ালেন আর বড়লোক করলেন কলেজ মালিককে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন কলেজের সঙ্গে ওদের চুক্তি থাকে সার্টফিকেট কেনার। কোনকোন ক্ষেত্রে ভুয়োও হয়। মাথা পিছু নামমাত্র টাকা দিলেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ম্যানেজম্যান্ট কলেজে না পড়লেও চলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের রোজ ক্লাস করানো হচ্ছে শুধুমাত্র টাকা হাতানোর জন্যে। এই সামান্য জিনিস বুঝতে পারেন না বলেই ঠগবাজদের পাল্লায় পড়ে প্রতিনিয়ত ঠকছেন অসংখ্য অভিভাবক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে। আর সেই পাতা ফাঁদে ছেলমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সাধারণ অভিভাবকেরা পা দিয়ে বিপদে পড়ছেন প্রতিনিয়ত। কয়েক মাস আগে ডিগ্রি বিক্রি চক্রের পর্দা ফাঁস করে বিধাননগর পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় সল্টলেকের কলেজ অব ম্যানেজমেন্টের দুই কর্তাকে। ডিসট্যান্স এডুকেশনের নামে ভুয়ো ডিগ্রি বিক্রি করার ব্যবসা এখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় চলছে জোর কদমে৷ ভিন রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তরের বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি বিক্রি করা হচ্ছে এই জেলায়৷ ডিসট্যান্স এডুকেশনের সেন্টারগুলোর দাবি, ভিনরাজ্যের বিভিন্ন বোর্ডের, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে৷ তাই তারা ডিগ্রি দিতে পারে৷ পাশাপাশি সেখানে তারা ভিনরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত লার্নিং সেন্টার বলেও দাবি করেন৷ ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়ছে ভুয়ো সংস্থা এইভাবে একাধিক ছাত্রছাত্রীকে ঠকিয়ে চলেছে সংস্থাগুলি৷ কিন্তু কোনও তদন্ত নেই। ধরপাকড় না থাকায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেদার লোক ঠকানোর কাজ চলছে জেলাজুড়ে। এমনকী ভুয়ো মেডিক্যাল ডিগ্রিও টাকার বিনিময়ে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। গত সেপ্টম্বর মাসে মেডিক্যাল ডিগ্রি বিক্রির অভিযোগে দিল্লি থেকে ধরা পড়েছিলেন কলকাতার দুই বাসিন্দা। তাঁদের ভবানীভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজ্যজুড়ে ভুয়ো চিকিৎসক এবং ভুয়ো মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়ে জোরদার অভিযান চালাচ্ছে সিআইডি। কাঁথি শহরেও বেশ কিছু ভুয়ো চিকিৎসক রয়েছে। তবে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর থেকে সাইনবোর্ড খুলে কেউ কেউ নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ থেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকে পরিনত হয়েছেন। কেউ আবার চেম্বার কয়েকদিনের জন্যে বন্ধ রেখে ছিলেন। সবটাই হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। ম্যানেজম্যান্ট কলেজ ফাঁদ পেতে রেখেছে আর আপনারা সেই ফাঁদে পড়ে হচ্ছেন সর্বশান্ত। ঝাঁ চকচকে বাড়ি, সুন্দরী রিসেপসেনিস্ট, শিক্ষক। সবটাই লোক দেখানো। প্রথম দর্শনে আপনার মন জয় করতে পারলেই তো আপনি মুগ্ধ হয়ে টাকা ঢালবেন ওখানে। ওখানে না পড়ে টাকা দিলে ওরাই সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে। তবে লাভ কম হবে তাই এমন কাজ ওরা করে না। ছাত্রছাত্রীদের সারা বছর ক্লাস করানো হয়। পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু কেউ কী জানেন খাতা কারা দেখেন? বা সার্টিফিকেট কে দেয়? একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। কেউ ওড়িশা, কেউ হায়দরাবাদ, কেউবা কর্নাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার কেউ কেউ বিনায়ক মিশন কলেজের নাম করে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। আপনি ক্লাস করছেন কাঁথি, রামনগর, কোলাঘাট, মেছাদা কিংবা হলদিয়ায়। আর সার্টিফিকেট পাচ্ছেন ভিন রাজ্যের কলেজগুলো থেকে। কেমন একটা রহস্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে তাইনা? গোলকধাঁধা আসলে ম্যানেজমেন্ট কলেজের মালিকেরা ঠিকাদারের কাজ করে থাকেন। আপনার ছেলে বা মেয়ে তিন বছর পড়ল। যখন চাকরি পাবে খুব বেশি হলে ১০হাজার টাকা বেতন। কেউ দুই মাস কেউবা ৬মাস হোটেলে কাজ করার পরে ছেড়ে পালিয়ে আসেন। কারণটা একটু খুঁজে দেখবেন। আর যে সার্টিফিকেট নিয়ে আপনার ছেলে হোটেলে কাজ করতে যায় তার কোনও মূল্য থাকে না হোটেলগুলোর কাছে। ওই সার্টিফিকেট না নিয়ে গেলেও আপনার ছেলে এমনিতেই ১০হাজার টাকা মাইনেতে কাজ পেতে পারে। তাই ডিসটেন্স এডুকেশন বা ম্যানেজমেন্ট কলেজের ফাঁদে পড়ার আগে একটু ভেবে দেখুন। সর্বশান্ত হওয়ার আগে একটু বাজিয়ে দেখুন। যারা পাশ করে হোটেল বা অন্য কোথাও চাকরি করছেন তাদের সঙ্গে কথা বলুন। হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের দিয়ে কী কাজ করাচ্ছেন। তারপরেই ছেলের ভবিষ্যতের জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। শুধু সার্টিফকেট থাকলেই হবে না, জীবনে সাফল্য আনতে হলে দক্ষতা বাড়াতে হবে। দেশে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টার সুযোগ নিয়ে কিছু অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোক ডিগ্রি বিক্রির দোকান খুলেছে। কিন্তু টাকায় কেনা এই ডিগ্রির কোনও মূল্য নেই। উলটে আপনাকে হাতকড়া পরতে হতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং যোগ্য কিনা তা প্রমাণ করতে হবে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিও সমান গুরুত্ব দিয়ে শিখতে হবে এবং পারলে আরো একটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যা বহির্বিশ্বে নানা ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে বলে দাবি করেছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শিক্ষামহল। তথ্যসূত্র: সংবাদ প্রতিদিন এআর/১৫:৪৮/১৪ ডিসেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2jvu8Ut
December 08, 2017 at 09:47PM
08 Dec 2017

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

:) :)) ;(( :-) =)) ;( ;-( :d :-d @-) :p :o :>) (o) [-( :-? (p) :-s (m) 8-) :-t :-b b-( :-# =p~ $-) (b) (f) x-) (k) (h) (c) cheer
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.

 
Top