মুম্বাই, ২০ এপ্রিল- চীনের দর্শকেরা প্রথমত থ্রি ইডিয়টস ছবি দেখে আমির খানের ভক্ত হয়েছেন। ছবিটি সে দেশে মুক্তি পায় ২০১১ সালে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার চাপে অতিষ্ঠ একদল চীনা শিক্ষার্থীর মনে এ ছবি নতুন করে আশা জাগায়। সেই বছরই গঠিত হয় চীনের প্রথম আমির খান ফ্যান ক্লাব। কিন্তু এটি তখন সীমাবদ্ধ ছিল কেবল চীনের বলিউডপ্রেমী দর্শকদের মধ্যে। এরপর ২০১৫ সালে পিকে ছবির প্রচার চালাতে জীবনে প্রথমবার চীনে যান আমির খান। তখনো এই বলিউড তারকা চীনের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে অতটা পরিচিতি পাননি। এরপর মাত্র তিন দিনে এই ছবি চীনে শীর্ষ আয়কারী ভারতীয় ছবির তালিকায় উঠে আসে। কিন্তু ভারতীয় মহাতারকা আমিরকে চীনের দর্শক সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করেন দঙ্গল ছবি দিয়ে। এই একটি ছবি চীনের বক্স অফিসের হিসাব-নিকাশের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চীনা নাগরিক হেন জিং জিংয়ের বয়ান থেকে একটি ঘটনা বলা যাক। ৩০ বছর বয়সী হেন বেইজিংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক। একদিন তিনি শুনলেন আমির খান বেইজিংয়ে আসছেন। ব্যাস, এরপর হেনকে আর পায় কে? ঝটপট সেদিনের ফ্লাইটের সময়সূচি দেখেই বিমানবন্দরে দে ছুট! দিনের মধ্যখানে সব কাজকর্ম ফেলে এই যুবক আমিরকে এক ঝলক দেখাতেই সোজা বিমানবন্দরে ছুটে গেলেন। কিসের আশায়? ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডেকে হেন জিং জিং বলেন, সেদিন আমি কয়েক মিনিট আমিরের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার এই অভিজ্ঞতা আমি জীবনেও ভুলব না। প্রশ্ন উঠতে পারে, কী জাদু আমিরে, যা জিংকে এত দূর টেনে নিয়ে গেল? আমিরের অসাধারণ অভিনয়নৈপুণ্য, ছবির ভাবনা ও বৈচিত্র্যময় গল্পই চীনের দর্শকদের তাঁর কাছে টেনে নিয়েছে। ৫০ ও ৬০-এর দশকে চৈনিক জনতা বলিউডকে চিনত রাজ কাপুরের নামে। সে অধ্যায় ফুরিয়েছে অনেক আগে। এরপর চীনের পরবর্তী প্রজন্ম ঝুঁকে পড়ে হলিউড, হংকং ও দক্ষিণ কোরিয়ার ছবির দিকে। একসময় সেসব ছবিও হলে খুব বেশি দর্শক টানতে পারছিল না। এদিকে বছরে ৩০টির বেশি আন্তর্জাতিক ছবি চীনের হলে মুক্তি দেওয়ার নিয়ম নেই। আর দেশি ছবিগুলোতেও ছিল আবেগের বড্ড অভাব। যান্ত্রিক জীবনে চীনের দর্শকেরা যখন চলচ্চিত্রের পর্দায় আবেগ খুঁজতে উৎসুক। তখনই তাঁদের তৃষ্ণা মেটাতে হাজির হন আমির খান। আমির খানের ছবির এক অভূতপূর্ব সাফল্যের সাক্ষী চীন। গত বছর মে মাসে সে দেশে মুক্তি দেওয়া হয় দঙ্গল। মুক্তির পরে ধাই ধাই করে বাড়তে থাকে ছবির বক্স অফিসের আয়। সে দেশে ১ হাজার কোটি রুপির বেশি আয় করে নেয় আমির অভিনীত জীবনীভিত্তিক ছবি। এর আগে মাত্র ৩২টি ছবি চীনে এত ভালো ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে সব কটিই হলিউডের। অর্থাৎ হলিউডের বাইরে দঙ্গলই চীনের একমাত্র বক্স অফিস মাতানো ছবি। চীনে এই ছবির ভালো ব্যবসার পেছনে যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। গত বছর আমিরের ছবিটির সাফল্যের পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে সেসব বিষয়ই তুলে ধরা হয়। চীন ও ভারতের সংস্কৃতিতে রয়েছে বেশ মিল। দুই দেশেই লিঙ্গবৈষম্য প্রকট। কমবেশি দুই দেশেই নারীরা বঞ্চিত। আর এ জন্যই প্রথমে দঙ্গল ও পরে আমিরের আরেক চলচ্চিত্র সিক্রেট সুপারস্টার গরম পিঠার মতো লুফে নেন চীনের দর্শক। দুটি ছবিতেই নারীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামী কাহিনি ফুটে উঠেছে। সেসব ছবিতে দেখানো হয়েছে রক্ষণশীলতার নামে নারীদের কোণঠাসা করে রাখার বিষয়। অনেকেই হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যান্ত্রিক সেই মানুষগুলোর মনে এখনো আবেগ খেলা করে। দঙ্গল ও সিক্রেট সুপারস্টার-এর সাফল্য যেন বিশ্ববাসীকে সেই কথাও নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য চীনে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে আমিরের দঙ্গল। চীনে বলিউডের ছবি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পিকক মাউন্টেন গ্রুপের পরিচালক প্রসাদ শেঠির মতে, দঙ্গল চীনে এখন শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়; একটি ভাবনার নাম। সে দেশের মানুষ এখন কথায় কথায় এই ছবির সংলাপ আওড়ায়; যা কিনা হলিউডের আয়রন ম্যান, স্টার ওয়ার্স-এর মতো দাপুটে ছবিগুলোও এত দিনে করতে পারেনি। ২০১৭ সালে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের সাংবাদিক রব কেইন এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে চীনে দঙ্গল ছবির জয়জয়কারের পাঁচটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, এই ছবির অভূতপূর্ব সাফল্যের অন্যতম কারণ মেগাস্টার আমির খান। এই ছবির সামাজিক গল্প ও গল্প বলার ধরনও চীনা দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে বলে তাঁর মত। দীর্ঘদিন ধরে নিজ দেশের নিম্নমানের ছবি দেখে দেখে বিরক্ত দর্শক দঙ্গল-এর মাধ্যমে অন্য রকম এক ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে হলে উপচে পড়েছেন। যেখানে হলিউডের বেশির ভাগ ছবি থাকে অ্যাকশনে ঠাসা। আর বলিউডের অন্যান্য ছবিতে মারপিটের সঙ্গে থাকে ধুমধাড়াক্কা নাচ-গান, সে ক্ষেত্রে আমিরের দঙ্গল একেবারেই আলাদা। চীনে এই ছবির সাফল্যের পেছনে নারীর ক্ষমতায়নকে আলোকপাত করাও একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন রব কেইন। তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পেয়েছেন ছবির জনপ্রিয়তার পেছনে। কনফুসিয়ান চীনে মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করার ব্যাপারে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। আর দঙ্গল-এ অভিভাবকের প্রতি দায়িত্ববোধের বিষয়টি দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। তবে চীনে আমিরের সফলতার মানেই কী বলিউডের সফলতা? এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা দরকার। আমিরের ছবিকে দর্শক যেভাবে গ্রহণ করেছেন, তা হিন্দি সব ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সেখানকার বেশির ভাগ দর্শকই পিকে, থি ইডিয়টস, দঙ্গল ও সিক্রেট সুপারস্টার দেখতে গিয়েছেন আমিরের কারণে, ছবিগুলোর গায়ে বলিউডের মার্কা দেখে নয়। চীনের বক্স অফিসের সূত্র ধরে একটি হিসাব দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। চীনে আমিরের মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি পিকে সে দেশে আয় করে ১২১ কোটি রুপি, দঙ্গল এর আয় ১ হাজার ৩৩০ কোটি রুপি, সিক্রেট সুপারস্টার চীনের বক্স অফিসে আয় করে ২৯৩ কোটি রুপি, যা এ ছবির ভারতীয় বক্স অফিসের আয়ের চেয়েও বেশি। এদিকে সালমান খানের বজরঙ্গি ভাইজান চীনে আয় করতে সক্ষম হয় ২৯৩ কোটি রুপি, অবশ্য ভারতে মুক্তির দুই বছর পর চীনে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়। তত দিনে অনেকেই ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে ছবিটি দেখে ফেলেছেন। আর চীনে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ইরফান খানের হিন্দি মিডিয়াম সিনেমার আয় মাত্র ১৪০ কোটি রুপি। এ ছাড়া বলিউডের বাকি যে ছবি চীনে মুক্তি পেয়েছে, তাঁর আয় উল্লেখযোগ্য নয়। মিস্টার পারফেকশনিস্ট চীনে আংকেল আমির ভারতে আমির খানকে ডাকা হয় মিস্টার পারফেকশনিস্ট বলে। আর চীনে লোকে তাঁকে ভালোবেসে নাম দিয়েছে আংকেল আমির। এতে করে বোঝা যাচ্ছে যেই দেশে আমিরের তরুণ ভক্তের সংখ্যাই বেশি। তবে দঙ্গল-এর পর চীনের ষাটোর্ধ্ব অনেক নাগরিককেও হলের বাইরে টিকিট সংগ্রহের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এই অভিনেতার চীনা ফ্যান ক্লাবের সক্রিয় ভক্তের সংখ্যা বর্তমানে ৫০০। আর ক্লাবের মোট সদস্যসংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। চীনে আমিরের হঠাৎ এত জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি নিজে কী ভাবছেন? আমির বলেন, চীনের দর্শকেরা আমার কাজ এত পছন্দ করছে, এ জন্য আমি ভীষণ আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত। আমার মনে হয়, ভারতীয় আর চীনাদের আবেগগুলো একই রকম। আমাদের সংস্কৃতিতেও অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। আমিরের সাফল্য ভারতীয় নির্মাতাদের চীনের চলচ্চিত্র বাজার নিয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে। চীন ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে আরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণের আলোচনাও হচ্ছে এখন। তবে চৈনিকদের কাছে ছবি বিক্রি করতে চাইলে আজগুবি কোনো গল্প আর এখন ধোপে টিকবে না। বাস্তব জীবনের আবেগগুলো এখন চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে গিলতে চাইছেন সে দেশের দর্শক। আমির সেই পথে হেঁটেই সফলতা পেয়েছেন। চলতি বছরের শেষে এ নায়কের ইতিহাসনির্ভর ছবি থাগস অব হিন্দোস্তানও চীনের দর্শকদের হৃদয় জয় করবে বলে বিশ্বাস। সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি ও ফোর্বস আর/০৭:১৪/২০ এপ্রিল
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2J6oMcL
April 20, 2018 at 03:04PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন