কলকাতা, ০৬ নভেম্বর- ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ তারপর থেকে ক্রমশ সমাজের মূল স্রোতে গ্রহণীয় হয়ে উঠছেন তাঁরা৷ বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান ঘিরেও ভাঙছে অচলায়তন৷ কলকাতাসহ শহরতলিতে এবার রূপান্তরকামীরা হয়ে উঠেছিলেন পুজোর মুখ৷ কিন্তু শহর ছাড়িয়ে সেই ছক ভাঙা ঢেউয়ের রেশ পৌঁছে গিয়েছে জেলাতেও৷ দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের অনীক দত্ত ওরফে অ্যানির বিয়েতে এবার পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষী থাকলো রূপান্তরকামী বিয়ের৷ মডেলিংয়ের সূত্রে আলাপ হওয়া একটি সম্পর্কের পরিণতি ছাদনাতলা৷ এমনটাই জানা গেল অ্যানির সঙ্গে জলপাইগুড়ির সাগ্নিক চক্রবর্তীর বিয়ের আসরে৷ তাঁদের দু বছর আগের সেই সম্পর্ক পরিণতি পেলো বিয়েতে৷ বিয়েটা সমাজের চোখে কেমন দাঁড়াবে বা পরিবার কী ভাবতে পারে ইত্যাদির মধ্যে না গিয়ে তিনি সরাসরি মণ্ডপেই ধরলেন রূপান্তরকামী অ্যানির হাত৷ ৩১ অক্টোবর বউভাতের আসরে পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাগ্নিক চক্রবর্তী পরিষ্কার বললেন, সবকিছু আমি জানতাম৷ ও যে রূপান্তরকামী এটা জেনেও ওর সঙ্গে প্রেম করি৷ তবে নতুন সম্পর্কে প্রবেশের জন্যই কি লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত অ্যানির? অ্যানি জানালেন, কারো জন্যে তিনি পুরুষ থেকে নারী হননি৷ নববধূর সাজে তিনি বলেন, আমার শরীরটা পুরুষের ছিল, কিন্তু মনটা ছিল নারীর৷ আত্মাকে কেউ বদলাতে পারে না৷ শরীরটাকে বদলানো যায়৷ শরীর ও আত্মাকে মিলিত করার জন্য অনীক থেকে অ্যানি হয়েছি৷ সাগ্নিকের সঙ্গে সম্পর্কের আগেই আমি লিঙ্গান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ আমাদের সম্পর্কের জন্য নয়৷ নিজেকে সম্পূর্ণ করার জন্যই আমার এই সিদ্ধান্ত৷ আর পাঁচজন রূপান্তরকামীর মতোই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা৷ তিনি বলেন, অতীতে ভালো-খারাপ দু রকমের অভিজ্ঞতাই আছে৷ আমি ছেলেদের স্কুলে পড়েছি৷ ফলে টিটকিরি শুনতে হয়েছে৷ কিন্তু শিক্ষকেরা ভীষণ সাহায্য করেছেন৷ অবশ্যই কলেজের সিনিয়র এবং বন্ধুদের কথাও বলতে হয়৷ অ্যানি একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন৷ পাশাপাশি তিনি একজন সুদক্ষ মেক-আপ আর্টিস্ট এবং নৃত্যশিল্পী৷ তিনি স্বনির্ভর৷ রূপ পরিবর্তনের পথে নিজের অস্ত্রোপচারের খরচ নিজেই বহন করেছেন৷ অ্যানি মনে করেন না বিয়েটাই জীবনের সব৷ ক্যারিয়ার এবং পায়ের তলার মাটিটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ এই দুটিতে সাফল্য এলে তবেই স্বপ্নপূরণ ঘটবে৷ তিনি স্পষ্টই বললেন, কলকাতায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা যে পুজোর উদ্ধোধন করছে, তা অনেকটাই লোক দেখানো৷ যদি কলকাতায় তৃতীয় লিঙ্গের গ্রহণযোগ্যতা এতটাই হতো, তাহলে রাস্তায় বেরোলে টিটকিরি শুনতে হয় কেন? নিজেদের প্রচারের জন্য তৃতীয় লিঙ্গের ব্যবহার হচ্ছে৷ তবে এটা ঠিক যে, মানুষের মানসিকতায় বদল ঘটছে৷ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সমাজ কতটা বদলেছে? অ্যানি বলেন, সু্প্রিম কোর্টের রায়ের পর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা পাল্টেছে এটা বোঝা মুশকিল৷ আমার ধারণা, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো আগের ভাবনাতেই আটকে আছে৷ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে আমরা আইনি বৈধতা পেয়েছি৷ সেটাই বড় কথা৷ তবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টালেই সমাজ পাল্টাবে না৷ অ্যানির সঙ্গে একমত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিন্হা৷ তিনি বলেন, অনীকের বিয়েটা একটা বিপ্লব৷ সুপ্রিম কোর্টের রায় যা-ই থাক, আইন যা-ই বলুক, মানুষের চেতনাই আসল ব্যাপার৷ এটা শহরাঞ্চল নয়, একটা গ্রামীণ এলাকায় বিয়েটা হচ্ছে৷ সেখানে সবাই যে বিয়েতে অংশ নিয়েছেন সেটাই সদর্থক৷ মানে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট৷ মানুষের মধ্যে এই সম্পর্কগুলো মেনে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের অবস্থান কোথায়? সেই নিরিখে অ্যানির বিয়ে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ? রূপান্তরকামী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক রঞ্জিতা বলেন, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যেখানে মেয়েদেরই সম্মান নেই, সেখানে রূপান্তরিত মানুষেরা কীভাবে জায়গা পাবে? গ্রামাঞ্চলে এখনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ঢিল ছুঁড়ে মারা হয়৷ সেদিক থেকে অ্যানিকে সাধুবাদ দিতে হয়৷ খোলামেলা আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রঞ্জিতা জানালেন, আমাদের সকলেরই কাজ সেরে ঘরে ফিরতে ভালো লাগে৷ সেজন্য সংসারের চাহিদাও স্বাভাবিক৷ কিন্তু সংসারের ভাগ্য সকলের হয় না৷ আমার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের একজন পুরুষের সম্পর্ক ছিল৷ কিন্তু সমাজের চাপে তিনি মেনে নিতে পারেননি৷ এদিকে আমিও লিঙ্গ পরিবর্তন করিনি, তাই বিয়ের মতো সম্পর্কে প্রবেশ করা হয়নি আমার৷ সাগ্নিককে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়৷ এই সাহস কতজনের থাকে ? অন্যদিকে সাগ্নিক বলেন, এই প্রেমের জন্য আমি শেষ অবধি দেখতে চেয়েছি৷ তাই দেখেওছি৷ সকলেরই তাই করা উচিত৷ তবে আমার বিয়েতে কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি৷ বিষয়টা আমাকে অবাক করেছে৷ বাড়িতে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবা তাতে মত দিয়েছিলেন৷ মায়ের কিছু প্রশ্ন ছিল, সেটা বুঝিয়ে বলার পর তিনিও মত দেন৷ পশ্চিমবঙ্গে এর আগেও রূপান্তরকামী বিয়ে হয়েছে৷ ২০১৬ সালে রূপান্তরকামী শ্রী ঘটকের বিয়ে ছিল রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী বিয়ে৷ শ্রী বলেন, আমি আড়াই বছর আগে বিয়ে করেছি৷ তখন কাজটা অনেক কঠিন ছিল৷ এখন অনেক কিছু বদলে গেছে, ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে৷ সামাজিক বিয়ে তো ঠিক আছে, আইনত স্বীকৃতিটা দরকার এবার৷ বালুরঘাটের মানুষের মধ্যে এই বিয়ে নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া? স্থানীয় নিউজ পোর্টাল সংবাদ সারাদিন-এর সম্পাদক পরিতোষ বর্মণ জানালেন, বালুরঘাট এমন বিয়ে আগে কখনো দেখেনি৷ এমন বিয়ের অভিজ্ঞতা প্রথম হলেও সবাই এটাকে খোলা মনেই মেনে নিয়েছে৷ তিনি বলেন, বালুরঘাট কখনোই অ্যানিকে ব্রাত্য হিসেবে দেখেনি৷ একদম প্রথমদিকে অবশ্য ওকে কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছিল৷ তবে অ্যানি এখন খুব পরিচিত মুখ৷ বিভিন্ন মহলে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর যথেষ্ট পরিচিতি আছে৷ ফলে বিয়ে নিয়ে কারোর বিরোধিতা করার প্রশ্ন নেই এখানে৷ আর পাঁচ-দশটা বিয়ের মতোই খুব সাধারণভাবে এই বিয়ে গ্রহণ করেছে বালুরঘাটের মানুষ৷ ওর জীবন সেটা ও কীভাবে কাটাবে, সেটা নিয়ে মানুষ ভাবিত নয়৷ তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে একে/০৬:১৩/০৬ নভেম্বর



from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/2QkAbK9
November 06, 2018 at 12:11AM

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top