সিলেট, ০৭ মার্চ - যেকোনো বিদায়ই বেদনার, যন্ত্রণার। আর সে বিদায়টা যখন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ও সফলতম ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়- তখন ভক্ত, সমর্থক, অনুরাগীর মন খারাপের একশটা কারণ থাকতেই পারে। মাশরাফি নিজেই বলেছেন, আমি ওয়ানডে অধিনায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। তবে নির্বাচকরা মনে করলে আমাকে ওয়ানডের জন্য বিবেচনায় রাখতে পারেন। তার মানে ধরেই নেয়া যায়, আজ ৬ মার্চ সিলেটে অধিনায়ক মাশরাফি বিদায় নিলেও পেসার মাশরাফি থেকে যাচ্ছেন। হয়তো খেলা চালিয়ে যাবেন আরও কিছুদিন। তারপরও ক্যাপ্টেন মাশরাফির বিদায়ের রাগিণীটা অন্যরকম। দেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে বাজছিল বিদায়ের করুণ সুর। চারিদিকে রাজ্যের আফসোস, ইশ মাশরাফি আর অধিনায়ক থাকবেন না, টস করতে নামবেন না। ভাবতেও যে কষ্ট হয়! সেটা যে শুধুই তিনি বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ও বেশি ম্যাচজয়ী অধিনায়ক বলে- তা নয়। আসলে বাংলাদেশ দলে অধিনায়ক মাশরাফি মানেই অনুপ্রেরণার প্রতীক, নির্ভীক-সাহসী এক অভিভাবক। যার শেখানো মন্ত্রে দীক্ষিত প্রতিটি ক্রিকেটার। তাই মাশরাফি মানে শুধু দল পরিচালনাকারী নন। বাড়তি উদ্যম এবং প্রাণশক্তির উৎসও বটে। বাংলাদেশ দল বিশেষ করে ওয়ানডে টিমের সাথে মাশরাফির সম্পৃক্ততাও অন্যরকম। অন্য আট-দশটা অধিনায়কের মত নয়। টিম বাংলাদেশে অধিনায়ক মাশরাফি অনেক কিছু। সহযোগী ক্রিকেটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক। সাকিব, তামিম, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নাইম শেখ-আফিফ হোসেনও মাশরাফি ভাই বলতে অজ্ঞান। এমন এক প্রবাদতুল্য অধিনায়কের বিদায়ী ম্যাচ দেখতে তাই মুখিয়ে ছিলেন সবাই। কেমন হয় অধিনায়ক মাশরাফির বিদায়?- সেটাই ছিল দেখার। কিন্তু যে ম্যাচকে ঘিরে সর্বোচ্চ উৎসাহ, আগ্রহ- তাতে হঠাৎ এসে বাগড়া দিল বৃষ্টি। শুধু বাঁধাই দিল না। টানা বর্ষণে প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা (২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট) বন্ধ ছিল খেলা। যখন বৃষ্টি নামে তখন সিলেট স্টেডিয়ামে চলছিল লিটন দাস আর তামিম ইকবালের উদ্ভাসিত উইলোবাজির অনুপম প্রদর্শনী। দৃষ্টিনন্দন আর নয়ন মনোহর যাই বলা হোক না কেন- সম্ভবত কম হবে। উইকেটের সামনে, পেছনে, চারদিকে বাহারি স্ট্রোক প্লে আর চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে মাঠ মাতাচ্ছিলেন দুই টাইগার ওপেনার। কিন্তু ৩৩.২ ওভারে বৃষ্টি চলে আসায় হঠাৎই হরিষে বিশাদের শঙ্কা জেগেছিল। অবশ্য অনেক লম্বা চওড়া বিরতির পর সে শঙ্কা কেটে যায়। বৃষ্টি থেমে আবার শুরু হয় ম্যাচ। অধিনায়ক মাশরাফির শেষ ম্যাচ শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় শেষ হলো । সবাই দেখলেন মুগ্ধ চোখে। কি দারুণ রাজসিক বিদায় হলো ক্যাপ্টেন মাশরাফির। অতি বড় সমালোচকও মানছেন এর চেয়ে সুন্দর ও মনে রাখার মত বিদায় আর হতে পারে না। এ বিদায়ের জন্য বোধকরি কোনো বিশেষণ আর উপমাই যথেষ্ট নয়। অবিস্মরণীয়, অনন্য অসাধারণ, দুর্দান্ত, রাজকীয় আর রাজসিক বিদায়- যাই বলা হোক না কেন মনে হবে যেন কম হয়ে গেল। এক ম্যাচে যা যা হতে পারে, তার সবই হলো। যার ফিরিস্তি দিয়েও শেষ করা কঠিন। এক কথায় অধিনায়ক মাশরাফির শেষ দিনটি থাকলো সোনালী সাফল্যে মোড়ানো আর এক ঝাঁক নতুন রেকর্ডের ম্যাচ হয়ে। কী হয়নি এক ইনিংসে? প্রথম ও যেকোনো উইকেটে সবচেয়ে বেশি রানের নতুন রেকর্ড হলো। যার স্রষ্টা হলেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। তারা দুজন একটি-দুটি নয়, তিন-তিনটি নতুন রেকর্ডের জন্ম দিলেন। প্রথম রেকর্ড গড়ার পথে লিটন দাস ও তামিম ইকবাল ভাঙলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হোসেন অপি। আজ থেকে ২১ বছর আগে ১৯৯৯ সালের মার্চে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দুই ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি আর শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মেরিল তিন জাতি টুর্নামেন্টে ১৭০ রানের জুটি গড়েছিলেন। যা দীর্ঘ দিন প্রথম উইকেটে ছিল বাংলাদেশের ওপেনারদের সর্বোচ্চ। আজ তা ভাঙলেন লিটন ও তামিম। তা ভেঙ্গে এমন এক উচ্চতায় গিয়ে থামলেন, যেখানে আর কবে কোন জুটি গিয়ে পৌঁছাতে পারবে- তা কে জানে? তামিম আর লিটন প্রথম উইকেটে তুলে দিলেন ২৯২ রান। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওয়ানডে ক্রিকেটে কোন জুটিতেই অত রান ছিল না বাংলাদেশের। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২২৪ রানের জুটি গড়ে নিজেদের নামকে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছিলেন। তামিম ইকবাল আর লিটন দাস আজ সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন। শুধু ভাঙলেনই না, ২২৪ কে টপকে গিয়ে থামলেন ২৯২ রানে। তার মানে আজ এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করলেন তামিম ও লিটন। ওপেনিং জুটির সর্বোচ্চ আর যেকোনো উইকেটে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ডটির যৌথ রূপকার এখন তারাই। সেটাই শেষ নয়। ব্যক্তিগত আর দলগত মাইলফলক আছে আরও। এতকাল একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসটি ছিল তামিম ইকবালের। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের মাটিতে ১৫৪ রানের ঐ ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। আজ অপরপ্রান্তে তামিম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তার সেই ১৫৮ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে ১৭৬ রানে গিয়ে থামলেন লিটন দাস। তার মানে এখন ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি লিটন দাসের। এর বাইরে আরও একটি দলগত অর্জনও হলো। বৃষ্টি ভেজা ও বিঘ্নিত এ ম্যাচে টাইগাররা বেঁধে দেয়া ৪৩ ওভারে তুললো ৩২২ রান। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের এর আগের সর্বোচ্চ দলগত স্কোরটিও ছিল ৩২২ রানের এবং ৭২ ঘণ্টা আগে এই মাঠেই ঐ রেকর্ড পুঁজি তৈরি হয়েছিল। আবার সেই রেকর্ড স্কোরটাই স্পর্শ করলো মাশরাফির দল। তবে একটা পার্থক্য আছে। তা হলো দ্বিতীয় ম্যাচে ছিল ৫০ ওভার আর আজকের ৩২২ রান হলো ৭ ওভার কম ব্যাট করেই এবং সব শেষে ধরা দিল বড় এক জয়। এক ম্যাচে এতগুলো কৃতিত্ব, অর্জন- ভাবা যায়! এ যে রেকর্ডের রেকর্ড। আর তা অধিনায়ক মাশরাফির শেষ ম্যাচে। এর চেয়ে স্মরণীয়, স্বপ্নিল, রঙিন, বর্ণিল আর সাফল্যে মোড়ানো বিদায় আর কী হতে পারে? সূত্র : জাগো নিউজ এন এইচ, ০৭ মার্চ
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe https://ift.tt/3cEW9TJ
March 07, 2020 at 01:49AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন