আবুধাবি, ২৬ এপ্রিল- আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এখন সেই অবস্থাটা আর নেই। নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পয়লা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা। প্রবাসের আবুধাবিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সারা দিনের আয়োজনটি করে মহিলা সমিতি। ২২ এপ্রিল শনিবার বাংলা স্কুলের অডিটোরিয়ামে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। তিনি তার বক্তব্যে আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে এই অনুষ্ঠানকে আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। তিনি সবাইকে মহিলা সমিতির এমন শুভ উদ্যোগের পাশে থাকারও আহ্বান জানান এবং সমিতির সদস্যদের প্রতিও গভীর আস্থা ব্যক্ত করেন। বৈশাখের গীত, বৈশাখী সাজ, পুরোনো দিনের গান দিয়ে সাজানো হয়েছে মঞ্চের নৈবেদ্য। বড়দের নয় শুধু, সেখানে ছোটদেরও ছিল বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা। তারা বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। নিজেরা আনন্দ করেছেন, অন্যদের আনন্দ দিয়েছেন। গোটা অনুষ্ঠান করে তুলেছেন উপভোগ্য। মহিলা সমিতি জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির মূল ধারায় কাজ করে যাচ্ছে। মন কাড়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা তাদের চর্চিত বিষয়কে উপস্থাপন করে। সংগঠনের সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান এই মূল্যবোধটি ধরে রাখার ব্যাপারে এ দিনও ছিলেন খুব মনোযোগী I তাইতো তাকে প্রতিটি ধাপেই দেখা গেছে তৎপর। তৃপ্তিও ছিল তার। জিতেছি কিংবা জেতার পথে, সে মুখের প্রকাশ ছিল এমনই। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পপি রহমান। সংগঠনকে স্বেচ্ছা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পপি মানেই বাঙালি মেয়ে। তার চলনে বলনে বাংলা, বাঙালির আবহমান জীবন। তিনি অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে বক্তব্য রাখলেন। সবাইকে নব বর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলেন। বললেন, ধন্য আমরা। অনুষ্ঠান সফল করার জন্য অভিনন্দন জানালেন সবাইকে। ষাটের দশকে বাঙালি চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালি আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তী সময়ে জাতির রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পয়লা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালির জাতিসত্তা, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে। আঞ্জুমান আরা। ডাক নাম শিল্পী তার। দুই অর্থেই তার যোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত। তিনি সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এত অনবদ্য হয়ে ওঠে সংগঠনের অনুষ্ঠান! বলেন অন্তর খুলে, মন দিয়ে কাজ করেন সবাই। গান গাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে থাকে প্রাণ। আমি অভিনন্দন জানাই। জাকিয়া হাসান এলি বলেন, সারা বছর আমরা অপেক্ষা করি এই দিনটির জন্য। পাশে তার আদরের কন্যা হেমিকা। সেদিকে চোখ ঘোরান, এই পর্বটির দিকে চেয়ে থাকে এই প্রজন্ম। আজকের দিনটিকে তিনি মিলনমেলা বলে অভিহিত করলেন। জাকিয়া সাংগঠনিক কাজে খুবই সক্রিয়। কীভাবে এতটা শ্রম দেন, জানতে চাই। মুখে তার একরাশ হাসি, ভালো লাগে বলেই করতে পারি, বললেন তিনি। এক সময় গ্রামবাংলায় পয়লা বৈশাখকে ধরে হিড়িক পড়ে যেত। কৃষাণ-কৃষাণীরা নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনো বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুনশিয়ানায় আলপনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। এখানেও নগরের তরুণী মায়েরা কম যাননি। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সবাই। স্নান সারেন, নতুন পোশাক পরেন। বৈশাখী সাজ সেজেছেন তারা। এ জন্য তিনটি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ফারজানা করিম এনি তার পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দ প্রকাশ করলেন সহচরীদের নিয়ে। অন্যরা বললেন, সুবেশির এমন সময় আসে যেন প্রতি দিন। পূর্ণা শবনম নতুন এসেছেন এই দেশে। সেই অর্থে অনুষ্ঠানে এবারই প্রথম তার অংশগ্রহণ। মহিলা সমিতির প্রতি অগাধ ভালো লাগা ব্যক্ত করলেন। সাংগঠনিক কাজে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা/ প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে। যায় যেন মোর সকল গভীর আশা...। কয়েক দিন যাবৎ তারা দলে দলে বাজারে গিয়েছেন। পছন্দের কাঁচা পণ্যটির জন্য। আগেই দোকানিকে ফরমাশ দিয়েছেন। আলম সুপার মার্কেট, নাসের স্টোর, আদিল ট্রেডার্স, এ জন্য তাদের বাধা। এদের মাধ্যমে তারা যথারীতি প্রয়োজনীয় পণ্য বুঝেও নিয়েছেন। সেই থেকে আজকের পিঠা-পুলি। তারা এখানে নৈবেদ্য সাজিয়েছেন। আপ্যায়ন করেছেন সবাইকে। বৈশাখ শুধু ঋতু চক্রের ধারাবাহিকতা নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য চেতনারই নাম। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বাংলা নববর্ষ উৎসবের কোনো তুলনা হয় না। অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঐক্য ও সংহতি আরও সুদৃঢ় করে। মহিলা সমিতির এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি উজ্জ্বল। নারীরা পরেছেন লাল-সাদা শাড়ি। হাতভর্তি কাচের চুড়ি। চুলে বেলি ফুল। শিশুরাও সেজেছে লাল-সাদার সাজে। পুরুষেরা এসেছেন পায়জামা পাঞ্জাবি পরে। বাংলার চিরায়ত সাজে নববর্ষকে বরণ করেছেন সবাই। সব জায়গায় রঙিনের ছড়াছড়ি। তাহমিনা রিক্তা গান গাওয়া নয় শুধু আরও আরও মাধ্যমে তার অন্তর্ভুক্তি I সাজগোজও তার বাইরে নয়। কথা বলার সময় আঁচলটা এমনভাবে গুছিয়ে নিলেন যেন শাড়ি পরেন সব সময়। বললেন, তুলনাহীন দিন। লাল রঙের শাড়ি পরে কাচের চুড়িতে হাত ভরেছেন শরিফুন্নাহার জনি। অনুষ্ঠান সম্পর্কে বললেন, দারুণ দারুণ! একই কথা বলেন সাইফুন নাহার জলি। বৈশাখে তারও অনন্য সাজ। বললেন, আমরা সৌন্দর্যকে ধারণ ও লালন করি। সৌন্দর্যের পেছনে ছুটি অবিরাম। সত্যিই তাই। ঘাসের ওপর বসে কিংবা দাঁড়িয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে তারা স্কুল মাঠে তোলেন পছন্দের ছবি। আজমেরী শেলি। বরাবরের মতোই হাসি হাসি মুখ তার। বলেন, আজ আর অন্য দিকে মন নেই। কেবলই আনন্দে ভাসিয়েছি সারা সময়। মঞ্চে গান গেয়েছেন তারা। বৈশাখী গানে তারা যুক্ত করেছেন আনন্দের ঢেউহৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে। এখনো সেই মোহ, সেই মুগ্ধতা তার। নিরু চুন্নু নিজের জন্য সময় দেন। তার তিন কন্যা আফরা, পায়েল ও তৃষা। এর চাইতে বেশি যত্ন নেন তাদের। নাচের প্রতি তার আগ্রহ। প্রার্থনা করলেন, ছোটরা যেন নাচের সঙ্গে বেড়ে ওঠে। মহিলা সমিতি প্রতি বছরই নতুন কিছুর সংযোজন করে তার অনুষ্ঠানে। এবার নতুন আকর্ষণ ছিল পুরোনো দিনের সিনেমার গানের সঙ্গে অভিনয়। চমকপ্রদ একটি পর্ব। অদ্ভুত মুনশিয়ানা আর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তারা। নিশ্চিত করে বলতে পারি, অনুষ্ঠানে রাজ্জাককবরীশাবানা থাকলে বলতেন, আমার অভিনয় ঠিক এমনটি হতে পারতো! দর্শকশ্রোতা অভিভূত হলেন, পঞ্চমুখ প্রশংসা করলেন। শিল্পীরা দেখিয়ে দিলেন, আমরা নারী, আমরা পারি। অনুষ্ঠানে রুহানি আফরোজকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ তিনি এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার অবদান সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। গোটা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কারিশমা এনাম। প্রকৌশলী হামিদ হাসান বলেন, সুশৃঙ্খল একটি আয়োজন। মতিউদ্দিন পুরোনো মানুষ। সেই হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধার। তার ভালো লাগা প্রকাশ করলেন হাত মিলিয়ে। মোহাম্মদ সেলিম ভিন্নভাবে আড্ডা দিচ্ছিলেন। বলেন, সমিতি আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি তুলে ধরেছে নিপুণভাবে। তিনি আরও যোগ করেন, ছোটরা এর মধ্য দিয়ে নিজেকে চেনার সুযোগ পায়, বড়রাও খুঁজে নেয় তার আত্মপরিচয়। বিলায়েত হোসেন হিরো মন্তব্য করেন, অসাধারণ! বলেন, সাঁওতালি নৃত্যসহ প্রতিটি পর্ব ছিল অভূতপূর্ব! বোরহান উদ্দিন সুযোগ নেন ষোলো আনা। ছবি তোলেন একটার পর একটা। সময়কে বেঁধে ফেলেন পরম যতনে। এইই আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা, বলেন তিনি। বিদেশ বিভুঁইয়ে ভাবনার প্রধান বিষয় হয়ে আসে মা ও শিশুর মমতাময় সম্পর্ক। সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে মা ও সন্তান পায় অনন্য মর্যাদা। ঠিক এইভাবে ভাবি আমি। সম্ভবত এই জন্যই এক সময়ে জ্বলে ওঠে আমার ক্যামেরা। ইশরা দাঁড়ায় তার মা জান্নাতুন নাহারকে নিয়ে। একই ছবিতে প্রমা, প্রিয়া আসে তাদের মা খাইরুল জান্নাতের পাশে। একই ভাবে ছবি তুলি হেমেকা আর তার মা জাকিয়া হাসান এলির। নাজ দাঁড়ায় তার মা নাজনীন এজাজের সঙ্গে। মজার ব্যাপার নাজিফা ছাড়ে না এই সংসর্গ। ছাড়বেইবা কেন, ও যে ওই মায়েরই সন্তান। সব দুঃখ-বেদনাকে ঝেড়ে ফেলে পরম আনন্দে তারা স্বাগত জানিয়েছেন নতুন বছরকে। জমে থাকা দুঃখ-গ্লানি বিন্দুমাত্র ছোঁয়ার সাহস পায়নি এই দিনে। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তারা দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও সফলতা কামনা করেছেন। দোর্দণ্ড গতিতে পুরোনো বছরের জঞ্জাল সরিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকুক, দেশে শান্তি বিরাজ করুক, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত হয় আয়োজনে। যাক পুরোনো স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি, অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।। ... ... ... আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ। মায়ার কুজ্বটিজাল যাক দূরে যাক।। মহিলা সমিতি অনন্য একটি অনুষ্ঠান উপহার দেয়। বরাবরের মতোই তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে। মঙ্গল কামনা করি আমরা। শুভ হোক আগামীর পথচলা। জয়তু মহিলা সমিতি। আর/১৭:১৪/২৬ এপ্রিল
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2pzeADV
April 27, 2017 at 12:51AM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন