১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর। তখনো বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীনে। এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্প তখন কেবল জেগে উঠেছে। এ সময় আখরি স্টেশন নামে একটি উর্দু ছবি মুক্তি পায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে বাঙালিয়ানার কোনো ছোঁয়া থাকবে, তা কল্পনাই করা যেত না। আখরি স্টেশন ছবিটি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। এ ছবির প্রতিটি গানে ফুটে উঠেছে বাংলার চিরচেনা সেই সুর, যা এ দেশের পথে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে খুঁজে পাওয়া যায়। সে সময়ের গ্রামীণ বাংলার পটভূমিতে নির্মিত এ ছবির কাহিনী নেয়া হয়েছে নারীবাদী লেখিকা হাজরা মাসরুরের উর্দু ভাষায় লেখা ছোটগল্প পাগলি থেকে। ছবিটির পরিচালনা, প্রযোজনা, সংলাপ ও সংগীত রচনা করেছিলেন উর্দু ভাষার বিখ্যাত কবি সুরুর বারাবাঙ্কভি। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছবি নির্মাণের একটি প্রাথমিক উদাহরণ হলো আখরি স্টেশন ছবিটি। এখানে উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্য, সমাজ নিয়ে এ দেশের মানুষের সচেতনতা ও বাঙালি পরিচয়ে নিজেদের গৌরবগাথা। জামিল নামে একজন প্রকৌশলীর স্টেশন মাস্টারের মেয়ে ফৌজিয়ার সঙ্গে প্রেমকে কেন্দ্র করেই এ ছবির কাহিনী, যিনি একজন দুর্নীতিপরায়ণ ঠিকাদারের চক্রান্তের শিকার হন। পাকিস্তানের বিখ্যাত অভিনেত্রী শবনম এ ছবিতে মানসিক বিকারগ্রস্ত নারী বা পাগলি জামিলার চরিত্রে অভিনয় করেন। রেলস্টেশনের প্লাটফর্মের পাশেই তিনি থাকেন। যদিও ছবিতে তার সংলাপ বেশি নয়। কিন্তু ছবিটিতে তার অভিনয় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার চরিত্র এখানে সমাজের নিষ্ঠুরতা ও দুর্নীতির বাস্তব চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে ও তার প্রতিফলন ঘটায়, যা সব ধরনের সমাজেই বিরাজমান। ছবিটির নির্মাতা সুরুর বারাবাঙ্কভি ছিলেন একজন লেখক ও কবি। তিনি আসলে ভারতের লখনৌ থেকে এসেছিলেন। পঞ্চাশের দশকে তিনি ঢাকায় বেশকিছু কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তখনই তিনি এ শহরের শৈল্পিক পরিবেশের প্রতি এতটা আকৃষ্ট হন যে, এখানে আঞ্জুমান ই তারাক্কি ই উর্দু সংগঠনের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব পেলে তিনি তা সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন। এবং তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। সংগঠনের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য ম্যাগাজিনগুলোয়ও কাজ করতেন। সেখানে কাজ করতে করতে তিনি ছবির জন্য সংলাপ লেখা ও সংগীত রচনা করতে শুরু করেন। গানের কথা ও কবিতার জন্য বারাবাঙ্কভিকে বেশি স্মরণ করা হলেও তিনি তিনটি ছবি প্রযোজনা করেন। এর মধ্যে একটি ছিল আখরি স্টেশন। এ ছবির জন্য গান লেখার সময় তিনি সহায়তা নেন এ দেশের অন্যতম সংগীত প্রতিভা খান আতাউর রহমানের। খান আতা আখরি স্টেশনের গানের সুরে মিশিয়ে দেন বাংলার লোকসংগীত, যা শুনলে প্রথমেই বাংলা গান মনে হবে। ছবিটিতে অ্যায় মেরে আনোখে হামারি গানটা সংগীতজগতের রত্নস্বরূপ। সুমধুর কিন্তু সাধারণ। গানটি গেয়েছিলেন এ দেশের বরণ্য শিল্পী বশির আহমেদ। আখরি স্টেশনের নায়িকা ফৌজিয়ার প্রতি নিজের ভালোবাসাকে প্রকাশের জন্য জামিল এ গানটি গেয়ে ওঠেন। বশির আহমেদের শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পাকিস্তানের বিখ্যাত প্লেব্যাক গায়ক আহমেদ রুশদির কণ্ঠের মিল পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বশির আহমেদ পাকিস্তানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রুশদি তখনো পাকিস্তানে জনপ্রিয় ছিলেন। পাকিস্তানের সংগীত পরিচালকরা তাদের প্রধান নেপথ্য গায়ক রুশদির মতো আরেকজনকে নিতে অপারগ ছিলেন। তাই তারা বশিরের প্রতি আগ্রহ দেখাননি। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং দেশের দ্রুতবেগে গড়ে উঠতে থাকা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য তিনি গান লেখা ও গাওয়ার প্রতি মনোনিবেশ করেন। ২০০৩ সালে সেরা গায়কের পুরস্কার পান। আখরি স্টেশন ছবিতে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক এবং শওকত আকবর। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই রাজ্জাক অভিনয় জগতে পা রাখেন। তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা এআর/১৭:৫৮/২০ নভেম্বর
from First Bangla interactive newspaper - Deshe Bideshe http://ift.tt/2zUdVBi
November 20, 2017 at 11:57PM
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন